দুর্গাপূজা নিয়ে আমাদের এই আলাপন আয়োজনে আমরা পূজার সাথে জড়িত কিছু খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলাপ দিবো। আজকে আমরা তাহলে ‘কলাবউ’ আর ‘বাপেরবাড়ি’ প্রসঙ্গ নিয়ে বলি।
কে এই কলা বউ? কেন তার পূজা করা হয়?
সপ্তমীর সকালে সপ্তমীবিহিত পূজা আরম্ভের পূর্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি হচ্ছে কলাবউ স্নান। কম বেশি আমরা সবাই দেখেছি প্রতিমা স্থাপনের একটা কোণায় সিদ্ধিদাতা গণেশের পাশে একটা কলা গাছকে সচরাচর লাল পাড় সাদা শাড়ি পরিয়ে সিঁদুর লাগিয়ে দাঁড় করিয়েপূজাকরাহয়।
সাধারণভবে এই প্রতিকৃতিকে আমরা গণেশের বউ বলে মনে করি। এটা আসলে ভুল ধারণা। ইনি স্বয়ং মা দুর্গারই একটি প্রতীক অর্থাৎ গনেশের জননী। এই প্রতিকৃতির আসল নাম ‘নবপত্রিকা’। নবপত্রিকা দেবী দুর্গারই প্রতিনিধি। দেবী শুম্ভ নিশুম্ভ বধের সময় অষ্টনায়িকা সৃষ্টি করেছিলেন এবং দেবী নিজেও উপস্থিত ছিলেন। দেবীর এই নয়টি রূপের সমন্বিত সৃষ্টি হচ্ছে নবপত্রিকা।
এই কলা গাছের সাথে আরো ৮ টি গাছ মোট ৯ টি গাছ মিলিয়ে নবপত্রিকা বানানো হয়। উদ্ভিদ গুলো হচ্ছে –
কদলী (কলা), কচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), ডালিম, অশোক, ধান ও মানকচু উদ্ভিদ।

এজন্যই এর আরেক নাম নবপত্রিকা। এই ৯ টি উদ্ভিদকে ভাবা হয় মা দুর্গার ৯ টি শক্তির প্রতীক। তাই নবপত্রিকার পূজা মানে মায়ের ৯ টি ভিন্ন ভিন্ন শক্তির রূপকে পূজা করা। কলাগাছের সাথে বাকি ৮ টি উদ্ভিদ এবং একজোড়া বেল অপরাজিতা গাছের লতা দিয়ে বেঁধে দেয়া হয়। এরপর লাল পাড় সাদা শাড়ি পড়িয়ে নারীর আকৃতি দেয়া হয়। এরপর স্নান করিয়ে, সিঁদুর পরিয়ে মায়ের ডান পাশে স্থাপন করা হয়।
পূর্বেই বলেছি নবপত্রিকা মায়ের ৯ টি ভিন্ন ভিন্ন শক্তির প্রকাশ। এই ভিন্ন ভিন্ন শক্তি বলতে কেমন তা বুঝাই, যেমন মহাভারতের অর্জুন… তিনি যখন স্রেফ কুন্তীর সন্তান তখন আমরা তাঁকে পার্থ, কৌন্তেয় বলে অভিহিত করি। যখন তিনি দুই হাত দিয়ে ধনুকে তীর চালাতে দক্ষতা অর্জন করলেন তখন তাঁকে সব্যসাচী ডাকা হলো। নিদ্রাকে জয়ের শক্তি অর্জন করার পর তাঁকে গুড়াকেশ বলা হলো- এমন।

তো এই ৯টি উদ্ভিদে অধিষ্ঠিত দেবীরূপগুলো হচ্ছে –
➡️ কলা গাছে শক্তিপ্রদায়িনী ব্রহ্মাণী
➡️ কচু গাছে দীর্ঘায়ুপ্রদায়িনী কালিকা
➡️ হলুদ গাছে সর্ববিঘ্ন বিনাশিনী উমা
➡️ জয়ন্তী গাছে যশোকীর্তিদায়িনী কার্তিকী
➡️ বেল গাছে লোকপ্রিয়কারিনী শিবানী
➡️ ডালিম গাছে অসুর বিনাশিনী রক্তবীজনাশিনী
➡️ অশোক গাছে শোকনাশিনী দুর্গা
➡️ মানকচু গাছে সম্পদদায়িনী ইন্দ্রাণী
➡️ ধান গাছে প্রাণরক্ষাকারিণী মহালক্ষ্মী

আমাদের এই প্রকৃতি পরিবেশ ঈশ্বরেরই দান। আর এতেই আছে আমাদের প্রাণরক্ষাকারী সমস্ত উপাদান। নবপত্রিকা পূজার মাধ্যমে আমরা মূল এই প্রকৃতিরই পূজা করি। প্রকৃতির সমস্ত রূপকে মায়ের মধ্যে কল্পনা করে শস্য, ধন-সম্পদ, সমৃদ্ধি ইত্যাদি সম্পর্কে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে এই নবপত্রিকা পূজা করা হয়।তাহলেআশা রাখি সামনে থেকে নবপত্রিকা কে গণেশের স্ত্রী বলে গুলিয়ে ফেলা হবে না। সকলে সুস্থ থাকুন এবং পূজার প্রস্তুতি নিন। সামর্থ্য অনুযায়ী দরিদ্রদের সাহায্য করুন।
কেনই বা বলি মা দুর্গা বাপের বাড়ি আসছে, কেনই বা তাঁকে ভাবি মেয়ে
মায়ের আগমনের আর মাত্র একটা দিন বাকি। সকলের মনে যেন একটা উৎসবের আমেজ। মা দুর্গা তাঁর ‘বাপের বাড়ি’ আসবেন বলে কথা। তাঁকে বরণ করে নেওয়ার আয়োজনে যেনো ত্রুটি না হয় সেদিকে নজর সবার। দম ফেলার ফুরসত নেই কোন পুজো মণ্ডপে। সবকিছুই ঠিকঠাক হওয়া চাই। আর এই সতর্কতা স্রেফ যেন সতর্কতা নয়, সাথে এক প্রগাঢ় আন্তরিকতাও মিশে থাকে।
কিন্তু কেন? অন্যান্য পূজার সময় তো এমন দেখা যায় না।দুর্গাপূজার আবহটাই কেন একদম আলাদা? শাস্ত্রের সাথে এর কোন যোগাযোগ আছে কি? নাকি আছে কোন লৌকিক পরম্পরা? কী এমন হয় ওই চারটা দিনে যে দশমীর দিন চোখের জলে বাঁধ মানে না?

আসলে যদি আমরা এই পূজার সূচনা বিন্দুতেও দেখতে যাই তো দেখি মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে আশ্বিনের সপ্তমীর দিন সকালে বর্ণনাতীত তেজের অধিকারিনী এক দশভুজা মহাদেবী কাত্যায়ন ঋষির আশ্রমে অবিভূর্তা হন। এখন খেয়াল করার ব্যাপার হচ্ছে ঋষি কোন নির্দিষ্ট ধ্যানে বসেননি বা ক্রিয়া করেননি যে তাঁর এরকম দর্শন হবে। কিন্তু আশ্রম প্রাঙ্গনে অপরিচিতা এক নারী, কিন্তু অদ্ভুত দর্শন এই সত্ত্বাকে দেখে তিনি কোন বিচলিত হলেন না। দেবীকে তিনি সন্তানভাবে সম্বোধন করলেন, “কন্যা…”। এটাই একটি কারণ দুর্গাপূজার সাথে মায়ের বাপের বাড়ি আসা নিয়ে আবেগ তৈরিতে। এইজন্য মায়ের আরেক নামও কাত্যায়নী।
প্রশ্ন আসতে পারে যে এত জায়গা থাকতে ওখানে কেন তিনি আবির্ভূতা হলেন। আসলে মহিষাসুর স্বর্গলোক, ভূলোক, পাতাললোক তিনখানেই অসুবিধা সৃষ্টি করে রেখেছিল।দেবতারা যখন তেজ পুঞ্জীভূত করেন তখন সেটা প্রকাশের জন্য উপযুক্ত স্থান তখন ওই আশ্রমটাই ছিলো। মানে ওখানে হিংসা, হানাহানি, অত্যাচার পৌছেনি তখনো। নিত্য হোমযজ্ঞ হতো। তাই দেবী ওখানে প্রকাশিত হন।
অষ্টমীর দিন নানা অস্ত্রে সজ্জিতা হয়ে, নবমীর দিন দারুণ যুদ্ধলীলা করে, দশমীর দিন মহিষাসুরকে বধ করে যখন কন্যারূপিনী কাত্যায়নী চলে যাচ্ছেন, তখন সন্তান বিরহের মতই বিষাদগ্রস্ত হন ঋষি কাত্যায়ন। সেই কারণে এই দিনটি কন্যা বিদায়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ঋষি কাত্যায়নের মতই শত শত প্রবীণ-প্রবীণাও কন্যাভাবে, আর আমরা নবীনরা মাতৃভাবে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে তাঁকে বিদায় দিই।

বাংলা ভক্তিবাদের দেশ। চৈতন্য মহাপ্রভুর দেশ। সাধক রামপ্রসাদের দেশ। আর ভক্তি মার্গে এই বিশাল অনন্ত অসীম ব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টাকে খুব আপন করে পাঁচটি ভাবে উপাসনা করা যায়। তার একটি হলো বাৎসল্য ভাব। ভক্তিরসামৃতসিন্ধু গ্রন্থে শ্রী রূপ গোস্বামী এই ভাব নিয়ে বলেছেন যে, এখানে ভক্ত ভগবানকে নিজের সন্তানের মত করে ভালবাসে। বাবা মা যেমন নিজে না খেয়ে-পরে সন্তানের জন্য সব সুখবিধান করে, ভক্তও ভগবানকে নিজের ছেলে বা মেয়ে ভেবে এমনটা করে। একটা পিপড়া দেখলেও সে ভাবে এটা আমার গোপালকে যদি কামড়ে দেয়… গোপালই যে ঐ পিপড়ার অন্তরে বা গোপালই তার স্রষ্টা- এসব ভারিক্কি কথা ভক্তের মনেই থাকে না। সে আনন্দের স্তরেই নিজেকে বিলীন করে দেয়। এই মা দুর্গাকে কন্যা ভাবাটাও তেমন, বাৎসল্য ভাবেরই একটি প্রকাশ। হিন্দুর দর্শন অনুভবের চেষ্টা না করলে এগুলো বোঝা যায় না।
Feature Image Courtesy: dailyhunt.in