৬৪ টি ঘর। বর্গাকৃতির। সাদাকালো ঘর। ৩২ টি গুটি। দুজন খেলোয়াড়। বুদ্ধির জোরে একজন অপরজনের ওপর প্রভুত্ব করে। কখনো আবার প্রতিদ্বন্দ্বীকে ভীষণভাবে অপদস্থ করে পরাজিত করে। বলছি দাবা খেলার কথা। সম্প্রতি এই দাবা খেলা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দিতে হয় নেটফ্লিক্সে গত অক্টোবরে মুক্তি পাওয়া ‘The Queen’s Gambit’ কে। Scott Frank ও Allen Scott এর পরিচালনায় ও Ana Taylor Joy এর অনবদ্য অভিনয় সিরিজটি দর্শকমহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। সিরিজটি তৈরি করা হয়েছে Walte Tevis এর ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত ‘The Queens Gambit’ উপন্যাস থেকে।
সিরিজটি মুক্তি পাওয়ার ২৮ দিনের মধ্যেই ৬২ মিলিয়নের বেশি দর্শক এটি নেটফ্লিক্স থেকে দেখেছে। আর টরেন্টের কল্যাণে এই সংখ্যা যে আরো বিশাল তা বলাই যায়। কেন বলছি দাবা খেলা ইদানিং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে! কারণ এই সিরিজটি মুক্তি পাওয়ার পর গুগলে How To Play Chess এ বিষয়ে অনুসন্ধান এর পরিমান গত ৯ বছরের মধ্যে করা অনুসন্ধানের দ্বিগুণ হয়েছে। সিরিজটিতে একটি মেয়ে কিভাবে অনাথ আশ্রম থেকে একজন আন্তর্জাতিক দাবাড়ু হয়ে ওঠে তা দেখানো হয়েছে।

তবে আজকে এই সিরিজটি নিয়ে কোনো বিস্তর মূল্যায়ন বা আলোচনা করব না। আজকে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিব এক দাবাড়ুর সাথে। বিখ্যাত বাংলাদেশি দাবাড়ু। মহিলা দাবাড়ু। পরিচয় করিয়ে দিব তার ৬৪ টি বর্গাকৃতির সাদাকালো ঘরের কৃতিত্বের সাথে। বর্গাকৃতির ৬৪ টি ঘরে দাপিয়ে বেড়ানো এক রাণীর সাথে। পরিচয় করিয়ে দিব বাংলাদেশের প্রথম মহিলা আন্তর্জাতিক দাবা মাস্টার রাণী হামিদের সাথে।
রানী হামিদ। দাবার রাজ্যের একেশ্বরী তিনি। নামের মত দাবাতেও তিনি রানী। তার আসল নাম সৈয়দা জসিমুন্নেশা খাতুন। ডাক নাম রানী। বিয়ের পর স্বামীর নাম যুক্ত করে হন রানী হামিদ। ক্রীড়া জগতে তিনি এই রানী হামিদ নামে পরিচিত। তার সুবিশাল পরিচয়ের আড়ালে তার আসল নাম কেউ তেমন জানেই না।

রানী হামিদ ১৯৪৪ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলায় জন্মগ্রহণ করে। তার বাবা সৈয়দ মমতাজ আলী পেশায় একজন পুলিশ কর্মকর্তা। মা কামরুন্নেসা খাতুন পেশায় একজন গৃহিনী। পিতার কর্মস্থল বারবার পরিবর্তনের কারণে চট্টগ্রামের নন্দনকানন গার্লস স্কুলে পড়াশোনা শুরু হলেও ম্যাট্রিক পাস করেন সিলেট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। ১৬ বছর বয়সে তৎকালীন পাকিস্তানের কর্মকর্তা আবদুল হামিদের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। তিনি একজন দক্ষ সাঁতারু ছিলেন। পরবর্তীতে আব্দুল হামিদ বাংলাদেশ হ্যান্ডবল ফেডারেশনের সভাপতিও ছিলেন।
আবদুল হামিদ ও রানী হামিদ এর তিন ছেলে এবং এক মেয়ে। তার বড় ছেলে কায়সার হামিদ বাংলাদেশের একজন ফুটবল তারকা। মেজো ছেলে সোহেল আহমেদ ও ছোট ছেলে ববি হামিদও জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড় ছিলেন। তার মেয়ে জেবিন হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর লাভ করেন।

রাণী হামিদের এই ৬৪ বর্গাকার সাদাকালো ঘরে পথচলার গল্পটা একটু মজার। ছোটবেলা থেকেই তিনি দাবা খেলা পারতেন। আবার পাকিস্তানি ক্যাম্পে বন্দি থাকার সময় টুকটাক দাবা খেলতেন। খুব সাধারণ করেই খেলতেন, সময় কাটানোর জন্য। ১৯৭৭ সালে তিনি যখন আনুষ্ঠানিকভাবে কোন দাবা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন তখন তার বয়স ছিল ৩৩। চার সন্তানের জননী ছিলেন তখন তিনি। তার সন্তানের বয়স তখন কারো ১০ কারো ৮/৭/৬ এমন। তার দাবা খেলার শিক্ষক বা কারিগর বলা যায় তখনকার সময়ের জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়ন ড. আকমল হোসেনকে। আকমল হোসেন ছিলেন রানী হামিদ এর প্রতিবেশী ও তার মেয়ের বান্ধবীর বাবা।
একদিন রানী হামিদ এর মেয়ে বাসায় এসে জানায় তার বান্ধবীর বাবা দাবাতে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। রানী হামিদ তখন তার মেয়েকে বলে একদিন আসতে বলো তোমার বান্ধবীর বাবাকে। তার সাথে দাবা খেলবো। সত্যি সত্যি একদিন দাবা খেলতে হাজির হলেন আকমল হোসেন। ড. আকমল হোসেনের সাথে খেলেই রানী হামিদ বুঝলেন তিনি দাবার তেমন কিছুই জানেন না। এরপর থেকে ড. আকমল হোসেন প্রতিনিয়ত তাদের বাসায় আসতেন। আর রানী হামিদও তার সাথে দাবা খেলে তার অনুশীলন চালিয়ে যেতেন। এভাবেই তার দাবা খেলার যাত্রা।

৩৩ বছর বয়সে ১৯৭৭ সালে তিনি প্রথম কোনো প্রতিযোগিতামূলক খেলায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৭ সালে নব-দিগন্ত সংসদ দাবা ফেডারেশন নারীদের জন্য প্রথমবারের মতো আলাদাভাবে দাবা প্রতিযোগিতা আয়োজন করে। তার পরের দুবছরও তারা এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। তিনবারই চ্যাম্পিয়ন হন রানী হামিদ। ১৯৭৯ সালে শুরু হয় জাতীয় মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ। ১৯৭৯-৮৪ সাল পর্যন্ত টানা ছয় বার জাতীয় মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হন রানী হামিদ। ১৯৮৮, ৯০, ৯২, ৯৬, ৯৮, ৯৯, ২০০১, ০৪, ০৬, ০৮, ০৯, ১১, ১৮, ১৯ প্রতিযোগিতায় মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়ন হন তিনি। ২০১৯ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ২০ বার চ্যাম্পিয়ন হন তিনি। জাতীয় প্রতিযোগিতায় এতবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড কারো নেই।
জাতীয় পর্যায়ে ছাড়াও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তিনি তার শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়েছেন। ১৯৮১ সালে তিনি প্রথম কোন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। কোনরকম আন্তর্জাতিক মানের কোচিং ও অভিজ্ঞতা ছাড়াই ভারতের হায়দ্রাবাদে প্রথম এশীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করে তিনি বেশ সুনাম অর্জন করেন। এছাড়াও ১৯৮৩, ৮৫, ৮৬ সালে ব্রিটিশ মহিলা দাবায় ৩ বার চ্যাম্পিয়ন হবার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেন তিনি। ১৯৮৪ সালে তিনি পুরুষ টিমের সদস্য হয়ে গ্রিসের দাবা অলম্পিকে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার উপাধি পান এবং আন্তর্জাতিক রেটিং লাভ করেন। ২০০৫ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি রানার্সআপ হন। ২০১৫ সালে কমনওয়েলথ দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদক অর্জন করেন তিনি।

১৯৭৭ সাল থেকে প্রতিযোগিতামূলক দাবা খেলায় যাত্রা শুরু রানী হামিদের। ৭৭ বছর বয়সে এসে এখনও তিনি খেলে যাচ্ছেন। এর মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন ২০ বার, যা অনন্য এক কৃতিত্ব। ২০১৯ সালে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর প্রথম আলোতে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন,
“১৯৭৭ সালে ঢাকায় মেয়েদের দাবা শুরু হয়। সেটা বেসরকারিভাবে। আমি তখন পুরোপুরি গৃহিণী। অথচ খেলায় চলে এলাম। এরপর ১৯৭৯ সালে প্রথম নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শুরু থেকে খেলে প্রথম ছয়বার টানা চ্যাম্পিয়ন হই। জাতীয় মিটে ২০টা শিরোপা বোধ হয় বিশ্ব রেকর্ড। আমি আসলে নিশ্চিত না। ৭৬ বছর বয়সে একজন চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম তুলেছে। তাকে সরিয়ে ৭৭ বছর বয়সে আমি চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম তুলতে চাই। তাই আগামী বছরটাও খেলার ইচ্ছা রাখি।”

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে তিনি একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে থাকবেন সবসময়। বিশেষ করে নারীদের জন্য। ক্রীড়াঙ্গনে পিছিয়ে পড়া নারী বা যেসব নারী ক্রীড়াঙ্গনে অংশগ্রহণ করতে চায়, সফলতা অর্জন করতে চায় তাদের জন্য অনুপ্রেরণা রানী হামিদ। ৬৪ টি সাদাকালো বর্গাকার ঘরের এই রানী, রানী হামিদ বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে আজীবন ‘দাবার রানী’ হিসেবে বাস করবেন।
Feature Image Courtesy: pbs.twimg.com