১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের মাটিতে তখন রক্তের তীব্র গন্ধ। ঘরে-বাইরে সর্বত্র অস্থিরতার রেশ। নেই কোথাও একটু নিরাপদ স্থান। এদিক ওদিক সবখানেই চোখে পড়ে রক্ত স্তূপ, কান পাতলেই শোনা যায় কান্নার রোল, যেন এক সাক্ষাৎ মৃত্যুকূপ। মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার প্রয়াসে। কিন্তু হাতে পর্যাপ্ত অস্ত্র নেই, নেই খাবারের কোনো ব্যবস্থা, নেই চিকিৎসার জায়গাও। ঠিক তখনই ছন্নছাড়া উদ্বাস্তু মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালেন পন্ডিত রবিশঙ্কর। শিষ্য তথা বন্ধু জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে আয়োজন করলেন কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ১লা আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত এই দাতব্য কনসার্ট হতে অর্জিত সকল অর্থসাহায্য রবিশঙ্কর দান করলেন বাংলাদেশের মানুষদের। তিনি আজ নেই তবে তার প্রতি বাংলার মানুষের আত্নার টান আজও রয়েছে দৃঢ়। তিনি শুধু বিখ্যাত সেতারবাদকই নন, তিনি বাঙালির পরম বন্ধু, বাঙালির দুঃখের সাথী।
রবিশঙ্করের জন্ম ও বেড়ে ওঠা
১৯২০ সালের ৭ এপ্রিল উত্তরপ্রদেশের বেনারসে বাবা শ্যাম শঙ্কর চৌধুরী ও মা হেমাঙ্গিনী দেবীর কোল আলো করে জন্ম হয় বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী, সুরকার ও সেতারবাদক রবিশঙ্কর চৌধুরীর। পৈতৃক নিবাস ছিল নড়াইলের কালিয়া উপজেলায়। বেশ সচ্ছল পরিবারেই জন্ম হয় রবিশঙ্করের। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট, বেশ আদর-আহ্লাদেই বড় হতে থাকেন তিনি। কিন্তু তার সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে বাধ সাধে যখন বাবা তাদেরকে রেখে বিদেশে পাড়ি জমান। আর শুরু হয় কষ্টের দিনাতিপাত। বাবা শ্যাম শঙ্কর চৌধুরী ছিলেন ঝালওয়ারের মহারাজার কর্মী। মাসিক দুশো টাকা বেতনে চাকরি করতেন তিনি। মাস শেষে নানা হাত ঘুরে মোটে ষাট টাকা আসত তার মায়ের হাতে। সেই দিয়ে কি আর সংসার চলে? উপায়ন্তর না পেয়ে কানের দুল, নাকের নথ বন্ধক রেখে সংসারের খরচ জোগাড় করতেন রবিশঙ্করের মা। এরকমভাবেই অতিকষ্টে বড় হয়ে ওঠেন আজকের বিখ্যাত সেতারবাদক রবিশঙ্কর।
নৃতাঙ্গন থেকে সেতারবাদক হওয়ার গল্প
চার ভাইবোনের মধ্যে বড় ভাই উদয় শঙ্কর আগে থেকেই নৃত্য জগতে বেশ সারা ফেলতে শুরু করেছেন। পরবর্তীতে রবিশঙ্করের মেধার পরিচয় পেয়ে তার দলে যোগ দেয়ার জন্য বলেন। একেতো সংসারে টানাপোড়েন তার উপর আবার অল্প বয়স। একপ্রকার ঝোঁকের বশেই রাজি হয়ে যান রবিশঙ্কর। সেই থেকে তার যাত্রারম্ভ। ১৯৩০ সালে ১০ বছর বয়সে বড় ভাইয়ের নাচের দলের সাথে প্যারিস ভ্রমণ করেন তিনি। দেখতে দেখতে অনেক কিছু আয়ত্ত করে ফেলেন। তারপর তিন বছরের মাথায় নাচের দলের সদস্যপদ লাভ করেন। নাচে বেশ পারদর্শী হয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রামের মারফতে ভ্রমণ করেন ইউরোপ, আমেরিকা। একবার ইউরোপ ভ্রমণকালে নাচের দলের সাথে যোগ দেন মাইহার রাজদরবারের প্রধান সংগীতশিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান। তিনি রবিশঙ্করকে দেখেই বুঝতে পারলেন, ঠিকমতো তালিম পেলে ছেলেটা একদিন বিশ্বজয় করবে। তিনি রবিশঙ্করকে একজন একক সেতারবাদক হিসেবে তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন এবং একটা শর্ত দিয়ে বসেন, শিক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই শিক্ষায় তাকে একনিষ্ঠ থাকতে হবে। এজন্য ইউরোপ ভ্রমণ শেষে নৃত্যদল ত্যাগ করে তালিম নিতে মাইহারে চলে যান রবিশঙ্কর। মাইহারে যাওয়ার পর তিনি দৃঢ় মনোযোগ দিয়ে সেতার বাজানো শিখতে শুরু করেন। রবিশঙ্করের একাগ্রতা আর নিষ্ঠা এবং সেতারের তাল, লয় সবকিছুই যেন মোহনীয় আবেশ সৃষ্টি করতে থাকে। আর তা দেখে মুগ্ধ হতে থাকেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান। সেসময় ওস্তাদের পুত্র বিখ্যাত সরোদ শিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ-এর সাহচর্যে আসেন পন্ডিত রবিশঙ্কর। দুজনের প্রতিভার যুগলবন্দী বিমুগ্ধ করত সবাইকে। ১৯৩৮-৪৪ সাল অবধি ওস্তাদের বাড়িতে থেকেই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের আদ্যোপান্ত আয়ত্ত করেন তিনি।
সঙ্গীত জীবনের শুরু থেকে শেষ (১৯৪৪-১৯৯২)
ওস্তাদের সাহচর্যে থেকে সঙ্গীতযন্ত্র ও ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের উপর পান্ডিত্য অর্জন করার পর ১৯৪৪ সালে রবিশঙ্কর মুম্বাই চলে আসেন। সেখানে তিনি ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের সাথে যুক্ত হন। এক বছর পর কবি ইকবালের‘সারে জাঁহা মে আচ্ছা’ কবিতায় সুর দিয়ে বেশ সুনাম অর্জন করেন। তারপর ১৯৪৯ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিও-র নয়াদিল্লি শাখায় সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করার আহবান পান এবং ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত অতি নিষ্ঠার সাথে কাজ করেন। ১৯৫০ সালের দিকে সিনেমার আবহ সঙ্গীতে কাজ শুরু করেন। বেশ কিছু হিন্দি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনায় কাজ করা ছাড়াও সত্যজিৎ রায়ের অপু-ত্রয়ী (পথের পাঁচালী, অপরাজিত, অপুর সংসার)-র মতো বিখ্যাত সিরিজের পরিচালকও ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে একক সেতার পরিবেশন করার সুযোগ পান তিনি। এরপর তিনি পাশ্চাত্য দেশে পারফর্ম করতে শুরু করেন এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তাও অর্জন করেন। মূলত এর মাধ্যমেই পণ্ডিত রবিশঙ্কর বিশ্বের কাছে ভারতীয় রাগ সঙ্গীত তুলে ধরতে সক্ষম হন। ১৯৫৬ সালে তার রাগ সঙ্গীতের উপর তিনটি রেকর্ড প্রকাশিত হয়। ১৯৫৮ সালে ইউনেস্কো সঙ্গীত উৎসবে পারফর্ম করেন তিনি। আর ঐ বছরেই প্রতিষ্ঠা করেন কিন্নর স্কুল অফ মিউজিক। যার প্রতিষ্ঠাকালীন মুম্বাই শাখা ছাড়াও বর্তমানে লস এঞ্জেলস এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় দুটি শাখা রয়েছে। ১৯৬৭ সালে তিনি দ্য মনেটারি পপ ফেস্টিভ্যালে সেতার পরিবেশন করেন এবং মেনহুইনের সাথে জার্মানির বেস্ট চেম্বার মিউজিক পারফর্মেন্স ফর ওয়েস্ট মিটস ইস্ট পুরষ্কারে ভূষিত হন। ১৯৭১ সালে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আয়োজন করেন এবং সেখানে সেতার পরিবেশন করে বাঙালীদের জন্য ফান্ড সংগ্রহ করেন। এরপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে অনেকদিন সঙ্গীত জগৎ থেকে আলাদা হয়ে বিশ্রামের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৮৯ সালে নৃত্যনাট্য ঘনশ্যাম এর মাধ্যমে আবার কাজে ফিরে আসেন। কিন্তু ১৯৯২ সালে আবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে স্থায়ীভাবে বিরতি নেন।
বিখ্যাত যত পুরস্কার আর সম্মাননা
পন্ডিত রবিশঙ্কর তার সঙ্গীত জীবনে অর্জন করেছেন ৪টি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড যার মধ্যে সর্বশেষ অ্যাওয়ার্ড তার মৃত্যু পরবর্তী সময়ে ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও পেয়েছেন নানা পুরস্কার, অর্জন করেছেন বিশ্বখ্যাত নানা সম্মাননাও। চলুন এক নজরে দেখে আসা যাক –
- ১৯৬২ সাল – ভারতীয় শিল্পের সর্বোচ্চ সম্মাননা ভারতের রাষ্ট্রপতি পদক
- ১৯৮১ সাল – ভারতের সর্বোচ্চ সুশীল সমাজ পুরস্কার পদ্মভূষণ পদক
- ১৯৯১ সাল – ফুকোদা এশিয়ান কালচারাল প্রাইজেসের গ্র্যান্ড প্রাইজ
- ১৯৯৮ সাল – সুইডেনের পোলার মিউজিক প্রাইজ
- ১৯৯৯ সাল – ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ভারতরত্ন পদক
- ২০০০ সাল – ফরাসি সর্বোচ্চ সিভিলিয়ান অ্যাওয়ার্ড লিজিয়ন অব অনার
- ২০০১ সাল – রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ কর্তৃক প্রদত্ত অনারারী নাইটহুড
- ২০০২ সাল – দুটি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড
- ২০০৩ সাল – আইএসপি এ ডিস্টিংগুইশড আর্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড, লন্ডন
- ১৪টি সম্মানসূচক ডক্টরেট
- ম্যাগাসাসে অ্যাওয়ার্ড, ম্যানিলা, ফিলিপাইন
- গ্লোবাল অ্যাম্বাসেডর উপাধি – ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম
- বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত দেশিকোত্তম
বিবাহ, পরিণয় অতঃপর আবার বিবাহ
পন্ডিত রবিশঙ্কর বৈবাহিক জীবন শুরু করেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের কন্যা অন্নপূর্ণা দেবীর হাত ধরে। বাবা আর ভাইয়ের মতো অন্নপূর্ণা দেবীও ছিলেন সঙ্গীত জগতের একজন অভিসারী। নামডাকও অর্জন করেছেন অনেক। দেখতেও ছিলেন বেশ সুন্দরী। ঠিক যেন রূপে লক্ষ্ণী, গুণে সরস্বতী। রবিশঙ্কর তার রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন-
“অন্নপূর্ণা ছিল খুব উজ্জ্বল আর দারুণভাবে নজরকাড়া। চোখ দুটো ভারি মিষ্টি আর গায়ের রঙ আলুভাইয়ের (ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ) চেয়ে ফর্সা”।
একই বাড়িতে থাকার সুবাদে দুজনের পরিচয় ছিল আগে থেকে। তবে বিয়ের আগে বিশেষভাবে কাছে আসার সুযোগ হয়নি তাদের। পারিবারিকভাবেই ১৯৪১ সালের ১৫ মে বিবাহ সম্পন্ন হয় এই দম্পতির। বিয়ের কিছুদিন পর অন্নপূর্ণা দেবীর তুমুল জনপ্রিয়তা, সম্পদের অসম বন্টন আর তাদের পুত্র শুভঙ্করের অসুস্থতার জের ধরে শুরু হয় সংসারে নানা অশান্তি। একসময় অন্নপূর্ণা দেবী সেতার বাজানো ছেড়ে দেন। এরপর নৃত্যশিল্পী কমলা শাস্ত্রীর সঙ্গে রবিশঙ্করের পরিণয়ের কথা জানতে পেরে মাইহারে চলে যান তিনি। এভাবেই সমাপ্তি ঘটে তাদের সংসারের।
তাদের বিবাহবিচ্ছেদের পর রবিশঙ্কর বিয়ে করেন আমেরিকান কনসার্ট উদ্যোক্তা স্যু জোন্সকে। পরবর্তীতে তাদের ঘরে জন্ম হয় আজকের বিখ্যাত পপ, জ্যাজ, পাশ্চাত্য লোকসংগীত শিল্পী ও সুরকার নোরা জোন্সের। এরপর আবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন বয়সে অনেক ছোট সুকন্যা কৈতানের সাথে। তাদের ঘরে জন্ম নেন বিখ্যাত সেতারবাদক অনুশকা শঙ্কর।
জীবনাবসান
বার্ধক্যজনিত নানা অসুবিধায় ভুগছিলেন তিনি। বেশ কয়েকবার অসুস্থ হয়ে পড়ায় আরও দূর্বল হয়ে যান রবিশঙ্কর। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা তীব্র হলে হাসপাতালে নেয়া হয় তাকে। হৃৎপিণ্ডের বাল্ব পরিবর্তনের জন্য অপারেশন করা হলেও বাঁচানো সম্ভব হয়নি তাকে। ২০১২ সালে ১১ ডিসেম্বর ৯২ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়াগোর স্ক্রিপস মেমোরিয়াল হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন জগদ্বিখ্যাত পণ্ডিত রবিশঙ্কর।
সেতারের সুরে তিনি ছিলেন, আছেন আর থাকবেনও। তার অনুসারীরা শ্রদ্ধাভরে তাকে স্মরণ করবে আজীবন। তার উক্তিতেই তিনি বলেছেন –
“I will keep playing as long as my body lets me, and as long as I’m wanted by my listeners.
Because music is the only thing that keeps me going.”.
Feature Image Courtesy: npr.org