মানব সভ্যতার প্রাচীন রোগগুলোর একটি হল স্কার্ভি। প্রাচীন মিশরে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে স্কার্ভির মতো রোগের অস্তিত্ব মিলে। অনুরূপ উপসর্গের উল্লেখ পাওয়া যায় চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক হিপোক্রেটিস এর লেখাতেও। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ক্রুসেডারদের বর্ণনায় স্কার্ভির স্পষ্ট দেখা পাওয়া যায়। নৌ-প্রযুক্তির উন্নয়নে সমুদ্র অভিযানের যুগে প্রবেশের পর স্কার্ভি প্রকট আকার ধারণ করে। ১৫শ থেকে ১৮শ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বহু নাবিক প্রাণ হারিয়েছে স্কার্ভিতে। পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামা তার ১৭০ জন সহযাত্রীর ১১৬ জনকেই হারিয়েছিলেন, যার প্রধান কারণ ছিল স্কার্ভি। ১৫১৯ সালে পর্তুগিজ নাবিক ফার্ডিনান্ড ম্যাগেলান স্পেন থেকে তিনটি জাহাজে ২৫০ জন সহযাত্রী নিয়ে যাত্রা করলেও শেষ পর্যন্ত ফিরে এসেছিল ছিল মাত্র একটি জাহাজ ও ১৮ জন অভিযাত্রী। জর্জ এ্যানসন তার দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় (১৭৪০—১৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দ) প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অভিযাত্রীকে হারিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক লোকই মারা গিয়েছিল যুদ্ধ বা অন্য কোনো কারণে; বেশিরভাগ মৃত্যুর কারণ ছিল স্কার্ভি। স্কার্ভি প্রতিরোধে নানা চেষ্টা ও গবেষণার মধ্যে স্কটিশ সার্জন জেমস লিন্ডই সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে লেবু জাতীয় ফলকে এর প্রতিষেধক হিসেবে মতামত প্রদান করেন। আধুনিক বিশ্বে স্কার্ভির প্রকোপ তেমন দেখা না গেলেও অনুন্নত, দারিদ্রপীড়িত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
স্কার্ভি কেন হয়?
এক কথায় বলতে গেলে, ভিটামিন সি এর অভাবে স্কার্ভি রোগ হয়। ভিটামিন সি শরীরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করে থাকে। কোলাজেন নামক প্রোটিন যা কানেক্টিভ টিস্যূর গঠন ও স্থায়িত্বের জন্য দায়ী, তার উৎপাদনে প্রয়োজন হয় ভিটামিন সি। কোলাজেন ব্যতীত টিস্যূগুলো ভেঙ্গে পড়ে। এই ভিটামিন ত্বকের সুস্থতা বজায় রাখে ও নানা ধরণের জীবাণু ত্বকের মাধ্যমে দেহে প্রবেশে বাধা প্রদান করে থাকে। খাদ্য উৎসে প্রাপ্ত সবচেয়ে সুলভ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হচ্ছে ভিটামিন সি যা শরীরকে ফ্রী-রেডিক্যালের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে। ভিটামিন সি শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি করে যা শরীরকে রোগপ্রতিরোধে সাহায্য করে থাকে। ভিটামিন সি খাদ্য থেকে দেহের প্রয়োজনীয় লৌহ শোষণে সাহায্য করে যার অভাবে অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা দেখা দিতে পারে। এছাড়া এই ভিটামিন ডোপামিন, এপিনেফ্রিনের মতো নিউরোট্রান্সমিটার সংশ্লেষণে সহায়তা করে থাকে। দেহে ভিটামিন সি এর অভাব দেখা দিলে শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলী ব্যাহত হয়ে স্কার্ভি রোগ হয়।
স্কার্ভির লক্ষণসমূহ
সাধারণত একাধারে তিন মাস খাদ্য তালিকায় ন্যূনতম ভিটামিন সি এর অস্তিত্ব না থাকলে স্কার্ভির লক্ষণগুলো দেখা দিতে শুরু করে। তবে প্রথমেই সব লক্ষণ প্রকাশ পায় না। ধাপে ধাপে মৃদু থেকে তীব্রতর উপসর্গ দেখা দেয়। প্রাথমিক পর্যায়ে অস্বাভাবিক অবসাদ, ক্লান্তি, ক্ষুধামন্দা, বমিবমি ভাব, পেশিতে বিশেষ করে তলপেট ও পায়ের পেশিতে ব্যথা হওয়ার মতো লক্ষণগুলো দেখা দেয়।
পরবর্তী ধাপে দাঁতের মাড়ি ফুলে যায় এবং মৃদু চাপেই রক্ত পড়তে শুরু করে। মাড়ি উষ্ণ হয়ে ওঠে এবং ব্যথা করে। মাড়ি থেকে দাঁত আলগা হয়ে যায়। মাংসপেশি ও অন্ধিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়।
এক সময় মাড়ি থেকে অনবরত রক্ত পড়া শুরু হয়। মুখ থেকে তখন পঁচা আষ্টে গন্ধ বের হতে থাকে। ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ হয়ে ত্বক লালচে রং ধারণ করে। পায়ের ত্বকে বড় কালশিটে দাগ হয়। চুল রুক্ষ হয়ে যায়, কুঁকড়ে যায় এবং সহজেই ভেঙ্গে পড়ে। চোখে ফোলা ভাব দেখা দেয়, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। মেজাজ খিটখিটে হয়, বিষণ্নতা ভর করে। ক্ষত শুকাতে দেরি হয়, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বহুলাংশে হ্রাস পায়। মাংসপেশি ও অস্থিসন্ধিতে রক্তপাত হয়ে শরীরে ফোলা ভাব দেখা দেয়। এসময় রোগীর শরীরে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। মাংসপেশি ও অস্থিসন্ধিতে তীব্র ও যন্ত্রণাদায়ক ব্যথা অনুভূত হয়।
বিনা চিকিৎসায় এই রোগ আরো জটিল রূপ ধারণ করতে পারে। দাঁত পড়ে যায়। জন্ডিস, ম্নায়ুরোগ, অনবরত রক্তক্ষরণ হয়। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে, খিচুনি ওঠে। রোগী হঠাৎ সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। এমনকি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
স্কার্ভি রোগে আক্রান্ত শিশুর মেজাজ খিটখিটে হয়। গা ব্যথার কারণে সারাক্ষণ কান্না করতে থাকে। হাড়ের গঠন দুর্বল হয় এবং সহজেই ভেঙ্গে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়।
ঝুঁকির ক্ষেত্রগুলো
শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় ভিটামিন সি উৎপন্ন হতে পারে না। তাই খাদ্য ও পানীয় এর মাধ্যমে শরীরের ভিটামিন সি এর চাহিদা পূরণ করতে হয়। অলভ্যতা, জীবনপ্রণালী বা অভ্যাসগত নানা কারণে দেহে ভিটামিন সি এর ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম —
• নিম্ন আয়, দুর্ভিক্ষ, বাস্তুহারা, শরণার্থী ইত্যাদি কারণে পুষ্টিকর তাজা ফলমূল ও শাক-সবজি গ্রহণে অপরাগতা;
• সীমিত, নির্দিষ্ট ও একই খাদ্য গ্রহণ;
• শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি;
• পরিপাকজনিত জটিলতা;
• একাকীত্ব, হতাশা ও ক্ষুধামন্দা;
• ধূমপান ও মদ্যপান;
• দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া;
• পানিশূন্যতা;
• বিশেষ শারীরিক অবস্থা যার কারণে শরীরের পুষ্টিগ্রহণ ক্ষমতা কমে যায়: রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি;
• ডায়ালাইসিস ও কিডনি ফেইলিউর।
শিশুদের ক্ষেত্রে :
• অপুষ্টিজনিত রোগে ভোগা মা;
• অসুষম খাদ্যতালিকা;
• মাতৃদুগ্ধের অভাব;
• পরিপাক ও বিপাকজনিত দুর্বলতা।
রোগ শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা
সাধারণত প্রাথমিকভাবে উপসর্গ লক্ষ্য করে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার বৃদ্ধি এবং ক্ষেত্রবিশেষ সম্পূরক ভিটামিন সি গ্রহণ করলে যদি উপসর্গ দূর হয়ে যায় তবে ধরে নেওয়া হয় শরীরে ভিটামিন সি এর অভাব দেখা দিয়েছিল। এছাড়া নিশ্চয়তার জন্য রক্তে ভিটামিন সি ও আয়রনের পরিমাণ জানার জন্য রক্তপরীক্ষা ও অস্থিসন্ধির এক্স-রে করা হয়ে থাকে।
মুখ বা ইঞ্জকেশনের মাধ্যমে সম্পূরক ভিটামিন সি গ্রহণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ক্লান্তি, অবসাদ, বিষণ্নতা ও ক্ষুধামন্দার মতো উপসর্গ থেকে শারীরিক অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করে। এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে গা ব্যথা, রক্তক্ষরণ, ত্বকের কালশিটে দাগ ও দুর্বলতা দূর হয়ে যায়। সম্পূর্ণ সেরে ওঠতে তিন মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
প্রতিরোধ
দৈনন্দিন খাবারে পর্যাপ্ত ভিটামিন সি এবং প্রয়োজনে সম্পূরক ভিটামিন সি গ্রহণের মাধ্যমে স্কার্ভি থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব।
টক জাতীয় ফল ও সবুজ শাকসবজিতে পর্যাপ্ত ভিটামিন সি রয়েছে। লেবু, কমলা, মাল্টা, আমড়া, জাম, জাম্বুরা, কাঁচা আম, পেঁপে, পেয়ারা ইত্যাদি ফল এবং বাঁধাকপি, টমেটো, গাজর ও আলুর ত্বকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি পাওয়া যায়।
সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের ক্ষেত্রে দৈনিক ৯০ মি.গ্রা. ও নারীদের ক্ষেত্রে ৭৫ মি.গ্রা. ভিটামিন সি গ্রহণ করা প্রয়োজন। স্তন্যদানকারী মায়ের ক্ষেত্রে ৩০ মি.গ্রা. ও ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে ৩৫ মি.গ্রা. ভিটামিন সি অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করার সুপারিশ করা হয়। তাই যদি নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমান ভিটামিন সি জাতীয় খাবার গ্রহণ করা হয় তবে খুব সহজেই স্কার্ভি রোগ থেকে নিজেকে বাঁচানো সম্ভব।
Feature Image Courtesy: myupchar.com
Reference:
• প্রথমআলো