হরিদাস ভট্টাচার্য পরিচালিত ১৯৬২ সালের সিনেমা ‘শেষ অঙ্ক’ সত্যিই একদম, যাকে বলে তাজ্জব করা, তাই করে দিয়েছে। পুরনো দিনের বাংলা সিনেমাগুলো যে কেবল দুজন নর-নারীর প্রেম ও প্রেমকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়া ঘটনা নিয়েই নয় সেটিই প্রমাণ করে এ সিনেমাটি। একটি বিদেশি গল্পের কেবল একটি উপাদান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রাজকুমার মৈত্র ও শ্যামল গুপ্ত যে ন্যারেটিভ তৈরি করলেন তা নিয়ে তুমুল উচ্ছ্বসিত হতেই হয়।
হিচকক বলেছিলেন যে দর্শক যখন গল্পের অপরাধী সম্বন্ধে অনেককিছু জানেন, তখন তা সাসপেন্স। আর যখন খুব কম জানেন তখন তা থ্রিলার। এই কাঠামো অনুযায়ী ‘শেষ অঙ্ক’ কে বলা যায় সাসপেন্স ও থ্রিলারের দুর্দান্ত সমন্বয়। যেখানে একদম শেষ মুহুর্তের আগ পর্যন্ত কাহিনী বোঝাই যায় না।

কাহিনীটি এমন যে বার্মার রেঙ্গুন নিবাসী উচ্চবিত্ত পরিবারের সুধাংশু গুপ্ত এখন কলকাতার বড় ব্যবসায়ী। সে আরেক উচ্চবিত্ত বাড়ির মেয়ে সোমাকে ভালবাসে। সুধাংশু আগে একবার বিয়ে করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা স্বচক্ষে দেখায় তার পূর্বের স্ত্রী কল্পনা মানসিক ব্যাধিগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল। শেষে একদিন রেঙ্গুনেই ট্রেনের নিচে লাফিয়ে সে আত্মহত্যা করে। এই বিষণ্ন অতীত জানানোর পরও সোমা ও তার পরিবার সহমর্মিতা নিয়ে সুধাংশুর পাশে দাঁড়ায়। দুজনের বিয়ের যখন সব ঠিকঠাক, তখন দেখা যায় প্রতারকগোষ্ঠীর একটি চক্র, যাতে সুধাংশু আর সোমা, উভয়ের বাড়ির গৃহকর্মীও যুক্ত, তারা মিলে সুধাংশুর মৃতা স্ত্রী সংক্রান্ত বেশ কিছু তথ্যপ্রমাণ লোপাট করছে। তারপর যখন বিয়ের দিন এসে হাজির হয় তখন ভরা মজলিশে ঐ প্রতারকগোষ্ঠীর একটি মহিলা উকিলসহ এসে দাবি করে যে সে সুধাংশুর প্রথম স্ত্রী কল্পনা। রেঙ্গুন থেকে উন্মাদ অবস্থায় মনিপুর চলে গিয়েছিল। সুস্থ হয়ে বহু খোঁজ করে এখানে এসেছে। এদিকে সুধাংশু জানে যে এর সাথে কল্পনার কোন মিলই নেই। ঘটনা আদালতে গড়ায় কিন্তু সকলরকম প্রমাণ সুধাংশুর বিপরীতে যেতে শুরু করে। এমনকি প্রতারকগোষ্ঠীর হোতাকে ধরেও লাভ হয় না। কিন্তু কেন?

এটুকু কিন্তু প্রথম চল্লিশ মিনিটের কাহিনী মাত্র। তারপর আদালত, ঘর, বাহিরে যা শুরু হয় তা এক টানটান উত্তেজনার গল্প। কোর্টরুমে বাদী ও বিবাদী পক্ষের দুই উকিলের বাদানুবাদে কতবার যে নিজেই টেবিল চাপড়ে উঠেছি তা বলার বাইরে। আর টুইস্টগুলোতে শিস আর “ওররে” বলে চিৎকার তো আছেই।
সুধাংশু চরিত্রে অভিনয় করেছেন মহানায়ক উত্তম কুমার। কী অভিব্যক্তি তার একেকটি সিকোয়েন্সে। যখন তিনি অফিসে চেক সই করছেন, যখন বাসায় গৃহকর্মী তার শরীরে কোট গলিয়ে দিচ্ছে, যখন তিনি প্রেমের কথা বলছেন, যখন তীব্র ক্রোধ নিয়ে বিরোধী পক্ষের উকিলের জেরার উত্তর দিচ্ছেন, যখন এই ফাঁদ থেকে বের হবার কোন দিশকুল পাচ্ছেন না- কী তার ক্যালিবারের রেঞ্জ! সাধে কি আর তাকে বলা হয় মহানায়ক!

সোমা চরিত্রে শর্মিলা ঠাকুরের কী স্নিগ্ধ উপস্থিতি ফ্রেমজুড়ে আর নকল কল্পনা হয়েও সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় (আপনাদের বহুল পরিচিত ‘প্রাক্তন’ সিনেমায় অভিনয় করেছেন) যে অসহায় অভিনয় করেছেন তাতে আপনিও সময়ে সময়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়বেন।
বাদী ও বিবাদী পক্ষের উকিল হয়েছিলেন যথাক্রমে উৎপল দত্ত আর কমল মিত্র। কী জাঁদরেল অভিনয় একেকজনের। বিশেষত উৎপল দত্তের উত্তম কুমারকে দেয়া ধমক, “কেস হারতে আমি পছন্দ করিনা” -কানে লেগে থাকার মতো।

এ-তো গেল ক্যামেরার সামনে যা মোটা দাগে দেখা যায় তা নিয়ে আলাপ। ক্যামেরার পিছনের কারিকুরি নিয়ে কথা বলি। প্রথমেই বলতে হয় এর সম্পাদনার কথা। ষাটের দশকে শত শত ফুট লম্বা ফিল্ম রিলের সম্পাদনা করা সহজ ছিল না। সাদা টেপ লাগিয়ে কোথায় কাটবে তা চিহ্নিত করে অনেক যত্ন করে দৃশ্যটুকু নিতে হতো। যে জন্য সেসময় অনেক সিনেমার এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্য যাওয়াটা ঠিকমত হতো না। আচমকা লাফ দিতো বলে খুব চোখে লাগতো। সন্তোষ গাঙ্গুলী এই সিনেমায় কাজটি দক্ষভাবে সামলেছেন। শট ডিভিশন এমনভাবে রেখেছেন যেন চরিত্রগুলোর মধ্যে চলা উত্তেজনা দর্শককেও ছুঁয়ে যায়। তেমনি শব্দযোজনার দায়িত্বে থাকা নৃপেন্দ্রনাথও।

এই সিনেমার ফ্রেমিংয়ে সবচেয়ে সুন্দর দিকটি হলো ফ্রেমের প্রতিটি ঘর সম্বন্ধে পরিচালকের সচেতনতা। সচরাচর হয় কি, আমরা যখন একটি এক চরিত্র বা দুই চরিত্রের জন্য ফ্রেম ধরি, তখন মূল ফোকাসটি ঐ দুজনই থাকে। কিন্ত্র সে ফ্রেমে যদি আরো লোকজন থাকে তখন পরিচালক সে ব্যাপারে থাকেন ভীষন অমনোযোগী। দেখা যায় দুর্দান্ত সংলাপ চলছে কিন্তু ফ্রেমের অন্যান্য লোকজনের মুখ ভাবলেশহীন। কী বাজে যে লাগে! এই সিনেমায় কোর্টরুমের যে দৃশ্যগুলো নেয়া হয়েছে তাতে সংলাপে তর্কে-বিতর্কে বাকিদের মুখের ভাবও প্রশংসনীয়। আর সাদাকালো সিনেমার যে গুরুত্বপূর্ণ দিক, দর্শককে রঙের অভাব বুঝতে না দেয়া, সেটিও এই সিনেমায় চমৎকার ভাবে বজায় রাখা হয়েছে।
সব মিলিয়ে বলা যায় আপনার লক ডাউনের দুটি ঘন্টা বৃথা যাবে না। সিনেমাটি ইউটিউবেই আছে। পুরনো বলে উদাসীন না হয়ে একবার দেখে নিলে ক্ষতি কী!
Feature Image Courtesy: Youtube.com