শরীফ ইমাম

“দেখা হয়েছিল সেই কিশোর বেলা। লাল গোলাপের পাঁপড়িতে লিখে পাঠিয়েছিল, ‘আমি তোমায় ভালোবাসি’। তুমিও কি…। হ্যাঁ, আমিও। সেই কবেকার, চার দশকেরও ওই প্রান্তের ১৯৪৩ সালের কথা। দুজনেই তখন রংপুর কারমাইকেল কলেজে ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষে পড়ি। পড়ার সুবাদে মুখচেনা ছিল। প্রথম সামনাসামনি দেখি কলেজের বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠানে। …সেই প্রথম ভালো করে দেখা। তারপর সেও দেখেছে আমায়। স্মৃতির ছবিরা সার বেঁধে চোখের সামনে ভেসে ভেসে চলে আসছে। ধুতি, শার্ট পরা শরীফ সাইকেল চেপে কলেজে যাচ্ছে, আমাদের ঘোড়ায় গাড়ি তাকে পার হয়ে চলে গেল। …কলেজের বার্ষিক নাট্যনুষ্ঠানে একলব্য অভিনীত হচ্ছে—তাতে গুরু দ্রোনাচার্য সেজেছে শরীফ। সে যা লাজুক, মুখচোরা ছেলে, তাতে প্রবল প্রতাপান্বিত, রাগী দ্রোনাচার্যের অভিনয়টাও ওই রকমই হয়েছে। …পরবর্তী সময় রক্ত গোলাপের পাঁপড়ি। সোনালী ফ্রেমের চশমার ভেতর দিয়ে দুচোখের মুগ্ধতা। তারপর প্রায় তিন দশক ধরে সে মুগ্ধতার আর শেষ ছিল না। শেষ হলো একেবারে ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর, তখন চিরতরে মুদিত হলো সেই চোখ দুটি।” প্রয়াত স্বামী শরীফ ইমামের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বর মাসে নিপুন ম্যাগাজিনের ১৫ বর্ষ পঞ্চম সংখ্যায় একথাগুলো বলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।

শরীফ ইমামের স্ত্রী শহীদ জননী জাহানারা ইমাম; Image Courtesy: dmpnews.org

প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, স্বল্পভাষী, নির্ভীক মানসিকতা, অমায়িক চরিত্রের অধিকারী ছিলেন শরীফ ইমাম। তার পুরো নাম শরীফুল আলম ইমাম আহমেদ। ৩০ অক্টোবর ১৯২৭ সালে জন্ম নেওয়া এই ক্ষণজন্মা মানুষটি স্বাধীনতার পূর্বে দেশের প্রকৌশল জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। রংপুর জিলা স্কুল থেকে ১৯৪২ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক, ১৯৪৪ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএসসি‌ ও কলকাতার শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পাস করেন। ডিজাইন বিভাগে তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৫০ সালে তিনি পূর্ব বঙ্গ সরকারের ‘কমিউনিকেশন এন্ড বিল্ডিং’ পরিদপ্তরের ডিজাইন বিভাগে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৮ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড এ যোগ দেন। ১৯৪৮ সালে তিনি জাহানারা বেগমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই পুত্র সন্তান শাফি ইমাম রুমী ও সাইফ ইমাম জামি।

স্ত্রী জাহানারা ইমাম ও দুই পুত্র জামি-রুমীর সাথে শরীফ ইমাম; Image Courtesy: sylhettoday24.news

শরীফ ইমামের উদার মনোভাব, সর্বাত্মক সহযোগিতা ও নির্দেশনার কারণেই জাহানারা ইমাম শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, সামাজিক পটভূমি সবদিক দিয়ে নিজেকে বিকশিত করতে পেরেছিলেন। শরীফ ইমাম সব সময় থেকে গেছেন পর্দার আড়ালেই। মূলত তার কারণেই তার স্ত্রী ও সন্তান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পেরেছিল। আর পরবর্তী সময়ে তারা আমাদের কাছে পরিচিত হয়েছেন শহীদ বীর বিক্রম শফি ইমাম রুমী ও শহীদ জননী জাহানারা ইমাম হিসেবে।

কতিপয় পাকিস্তানি দোসর, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ছাড়া ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে এদেশের সকল মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। এটি ছিল আমাদের জাতীয় যুদ্ধ। শরীফ ইমাম বলতেন, “আমরা যারা বর্ডার ক্রস করে যুদ্ধে যেতে পারেনি তাদের কিন্তু দেশে বসেও অনেক কিছু করার আছে।” তিনি শুধু এটি বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তার কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আর্থিক সহযোগিতাসহ সর্বাত্মকভাবে ওই ভয়াবহ দিনগুলোতে‌ তিনি মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছিলেন।

শরীফ ইমাম; Image Courtesy: prothom-alo.com

১৯৭১ এর জুন মাস। মেলাঘর থেকে সেক্টর-২ এর কমান্ডার খালেদ মোশারফের চিঠি নিয়ে শরীফ ইমামের বাড়িতে আসেন শাহাদাত চৌধুরী ও হাবিবুল আলম। খালেদ মোশাররফ বাংলাদেশের সব ব্রিজ ও কালভার্ট এর তালিকা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। সেইসঙ্গে ব্রিজ ও কালভার্ট ওড়ানোর ব্যাপারে কতগুলো তথ্য। ব্রিজ ও কালভার্ট এর ঠিক কোন পয়েন্টে এক্সপ্লোসিভ বেঁধে ওড়ালে ব্রিজ ভাঙবে অথচ সবচেয়ে কম ক্ষতি হবে অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হবার পর খুব সহজে মেরামত করা যাবে এই তথ্যগুলো। উদ্দেশ্য ছিল দেশের ভেতরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যোগাযোগ ও চলাচল ব্যবস্থাকে অচল করে দেওয়া। তবে সারাদেশের ব্রিজ‌ আর কালভার্টের তালিকা তৈরি করা সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শরীফ ইমামকে এ কাজটি করতে হয়েছিল। এজন্য প্রথমে তার দরকার হয়েছিল রোডস এন্ড হাইওয়ে ডিজাইন ডিভিশন থেকে ব্রিজের ফাইলগুলো সরানো। সেখানে অবাঙালি এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার কর্মরত থাকা অবস্থায় ফাইলগুলো বের করে আনা ছিল অত্যন্ত দুরূহ কাজ। এ কাজে তাকে সাহায্য করেছিল চিফ ইঞ্জিনিয়ার মশিউর রহমান। সুকৌশলে ফাইল অফিস থেকে নিয়ে যাওয়া হয় শরীফ ইমামের বন্ধু সামাদ সাহেবের বাসায়। সেখানে শরীফ ইমাম ও এস. আর. খান বাঁকা একপ্রকার আহার নিদ্রা ত্যাগ করে ৩৫০০ ব্রিজ আর কালভার্টের তালিকা তৈরি করেন। তাদের দুজনের হাতের লেখা যাতে চেনা না যায় সে জন্য দুজনের হাতে লেখা অংশগুলো অন্য একজনকে দিয়ে আবার কপি করানো হয়। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে শরীফ কাজটি সম্পন্ন করেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তালিকাটি তুলে দেন।

বাঁ থেকে জামি, জাহানারা ইমাম, শরীফ ইমাম, রুমী; Image Courtesy: Campus News

শরীফ ইমামের বাসভবন ‘কনিকা’ মুক্তিযুদ্ধের সময় গেরিলা যোদ্ধাদের জন্য ছিল নিরাপদ আশ্রয়স্থল। গেরিলাদের পদচারণায় মুখরিত ছিল কনিকা। গেরিলা যোদ্ধা রুমির সহযোদ্ধারা নিয়মিত আসা-যাওয়া করতো এখানে। নিরিবিলিতে যুদ্ধের প্ল্যান করার জন্য তারা কনিকা তে এলে তিনি তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করতেন। এমনকি ২৫ আগস্ট ১৯৭১ সালে ধানমন্ডিতে গেরিলা অপারেশন শেষে গেরিলাদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখতে কোন প্রকার হীনমন্যতা ছাড়াই তিনি সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিলেন। ২৯ আগস্ট আনুমানিক রাত বারোটার দিকে রুমী, জামি, শরীফ ইমাম‌‌ ও‌ হাফিজ কে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনীরা। ২ দিন অমানুষিক নির্যাতনের পর রুমীকে রেখে বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপরেও শরীফ ইমাম দমে যাননি। যেভাবে পেরেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে গেছেন।

রুমীকে ছাড়িয়ে আনার জন্য শরীফ ইমামের বন্ধু বাঁকা ও ফকির সাহেব মার্সি পিটিশন এর কথা বললেও তিনি রাজি হননি। তিনি বলেন যে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তার ছেলে যুদ্ধ করেছে তাদের কাছে মার্সি পিটিশন করলে রুমীর আদর্শকে হেয় করা হবে। রুমীর আদর্শকে সমুন্নত রাখতে তিনি নতি স্বীকার করেননি সামরিক জান্তাদের কাছে। ফলশ্রুতিতে হয়েছিলেন তিনি পুত্রহারা।

ছেলে রুমীর সঙ্গে শরীফ ইমাম; Image Courtesy: prothomalo.com

আর পুত্র হারানোর এই শোক নিয়েই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর চরম অপমান সহ্য করেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করে গিয়েছিলেন। পুত্রশোক এবং পাকিস্তানি আর্মির বন্দিশিবিরে তিনদিনের অমানসিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে ধীরে ধীরে তার জীবনীশক্তি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছিল। যে স্বাধীনতার জন্যে তার এতো ত্যাগ, যে স্বাধীনতার জন্য পুত্রশোক, সেই স্বাধীনতার রক্তিম লাল সূর্যটা বাংলার আকাশে উদিত হওয়ার মাত্র ৩ দিন আগে ১৩ ই ডিসেম্বর তার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়। বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসেও চূড়ান্ত বিজয় দেখে যেতে পারেননি তিনি। এভাবেই এক নীরব কর্মী এবং মুক্তিযুদ্ধের যথার্থ সহযোগী সবার আড়ালে নিঃশব্দে চলে গেলেন। তার মতো এমন আরো অনেক দেশপ্রেমিক, স্বাধীনতাকামী নীরব কর্মীদের জন্য আমরা পেয়েছি এক স্বাধীন ভূখণ্ড। বুকভরা শ্রদ্ধা ভালোবাসা তাদের জন্য। এই বাংলা যতদিন থাকবে ততদিন তারা বেঁচে থাকবে এই বাংলার মানুষের বুকে।

Feature Image Courtesy: prothomalo.com