কুমিল্লায় শো শেষে বাড়ি ফিরছিলাম। ফেরার পথে দূরপাল্লার এক ট্রাকের সাথে ঘটে দূর্ঘটনা। কালভার্টের বাইরে চলে যায় গাড়ির দুটো চাকা। ভাগ্যক্রমে বের হয়ে আসতে পারি আমরা। পরদিন ট্রেনে করে ফিরে আসি ঢাকাতে।’
একটু হলেই শেষ হয়ে যেত সব স্বপ্ন। শেষ হয়ে যেত শূন্য থেকে শুরু করার সকল অভিপ্রায়। তবে ভাগ্যকে নিজের আয়ত্তে এনে আজ স্টেজে উঠলে শুনতে পারেন দর্শকদের জয়ধ্বনি। নিজেদের সুরে পরিচিত মুখ তারা। তারাই আজ জিরো থেকে হিরো হওয়ার উদাহরণ। নাম যার ব্যান্ড শূন্য।

২০০৬ সাল। এমিল এবং শাকের দুই বন্ধুর পরিচয়। আড্ডা দিতে গিয়ে বেশ ভালোই সখ্যতা গড়ে ওঠে দুজনের। আড্ডার ফাঁকে গানও চলে বেশ। প্রশংসাও করে সবাই। অনেকে বলে একদিন বেশ নাম করবে তারা। উৎসাহ পেতে শুরু করেন। হুট করেই ভাবনা আসে, ‘নিজেদের তৈরি করা সুরের ধ্বনি যদি সবাইকে শোনানো যায়?’ ব্যাপারটা বেশ মন্দ নয় বটে। এরপর তাদের সাথে যোগ দিলেন লাবিব। যুক্ত হলেন মাইকেলও। যাত্রা শুরু হয় চারজন তরুণের। এরপর চিন্তা করেন অ্যালবাম প্রকাশের। যেই ভাবা সেই কাজ। পূর্ণ উদ্যমে এক প্রকার ঝাঁপিয়ে পড়েন চার জন।

২০০৭ সাল। ফুয়াদ আল মুক্তাদিরের মিক্সড অ্যালবাম বন্য এর জন্য একটি গান রচনা করে ফেলেন ‘প্রত্যাশা’ শিরোনামে। গান তো গাওয়া হলো সুপারহিট ধাঁচের। কিন্তু নাম? কারা গাইলো, কী তাদের পরিচয়? অতঃপর আবার ভাবনার শুরু। চারজন মিলে ব্যান্ডের নাম দিলেন শূন্য। আর এই ছোট্ট শূন্যর লাইনআপ: এমিল (ভোকাল), মাইকেল (বেজিস্ট), শাকের (লিড গিটারিস্ট), লাবিব (ড্রামার)। অতঃপর প্রকাশিত হলো অ্যালবাম। আর শূন্যর প্রথম গান প্রকাশ পেল একটি অ্যালবামে৷ শ্রোতাদের পছন্দও হলো বেশ। এক গানেই শূন্য ব্যান্ড জয়ধ্বনি শুনতে পারল মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে। সময় এল আরেক ধাপ আগানোর। এবার স্বপ্ন নিজেদের একক অ্যালবাম প্রকাশের। একক গান প্রকাশের পথটা তুলনামূলক মসৃণ হলেও অ্যালবাম প্রকাশের বেলায় তা হয়নি। বরং পথটা ছিল হোচঁট খেয়ে হেরে যাওয়ার অথবা উঠে দাঁড়ানোর। প্রথম অ্যালবাম প্রকাশে রাজি হয়নি কেউ। ঘুরতে হয়েছে সবার দ্বারে দ্বারে। নিজেরাই ঢাকা-চট্রগ্রাম ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরেছেন। গিয়েছেন দোকানে দোকানে। অনুরোধ করেছেন তাদের গান শোনার জন্য। কেউ রাজি হয়েছেন, কেউ হননি।

তবে হেরে যায়নি শূন্য। পুরো অ্যালবামের কাজ সম্পূর্ণ করে গিয়েছেন নানা প্রযোজকের কাছে। প্রথম অ্যালবাম প্রকাশের ঝুঁকি নিতে চায়নি কেউই। এরপর অ্যালবাম প্রকাশের জন্য প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘মেরুন মিউজিক’ গড়ে তুলেন নিজেরাই। সে সময় গান রচনার ফাঁকে ঢাকা-চট্রগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত কনসার্টে যোগও দিত চার তরুণের ব্যান্ড শূন্য। অতঃপর ২০০৮ সালে শূন্যর নিজস্ব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান মেরুন মিউজিকে প্রকাশিত হয় প্রথম অ্যালবাম ‘নতুন স্রোত।’ এরপর ফাহিম মিউজিক অ্যালবামটি বের করে।

প্রথম অ্যালবাম প্রকাশের পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি শূন্যর। এরপর প্রকাশিত হয়েছে একাধারে নানা অ্যালবাম- শত আশা (২০০৯), গড়বোবাংলাদেশ (২০১১), ভাগো (২০১৪), লটারি (২০১৭)। ব্যান্ডটি একে একে পেয়েছে দর্শক-শ্রোতার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। পেয়েছে নানা পুরষ্কার। ২০০৮ সালে প্রথম অ্যালবাম নতুন স্রোত দিয়েই পুরস্কারের যাত্রা শুরু। সে বছর মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার সেরা ব্যান্ড বিভাগে মনোনয়ন পায় শূন্য। ২০০৯ ও ২০১১ সালে সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড পায় শূন্য।

তরুণ প্রজন্মের কাছে শূন্য যেন এক রোল মডেল। ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্য সমর্থন ও উৎসাহ দিতে ইউনিগ্যাস ও শূন্য ব্যান্ড মিলে তৈরি করেছিল ‘চলবে লড়াই’ শিরোনামের একটি গান। প্রকাশিত হয়েছিল মিউজিক ভিডিও আকারে। বিশ্বকাপের আগের ত্রিদেশীয় কাপে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ও দর্শকদের উজ্জীবিত করছে এ গানের ‘ভাবনার কিছু নাই, চলবে লড়াই’ থিম। তানভীর চৌধুরীর কথায় শাকের রাজার অডিও নির্মাণে এ গানটি গেয়েছেন শূন্য ব্যান্ডের ইমরুল করিম এমিল। গানটির মাধ্যমে অর্জন করেছে লাখো ক্রিকেট ভক্তের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা।

বর্তমানে শূন্য ব্যান্ডের পরিধি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতে। নানা উপলক্ষে কনসার্টের জন্য তারা ডাক পায় দেশ-বিদেশে। তবে শূন্যর জন্মভূমির প্রতি টান বরাবরের ন্যায় বেশ গভীর। তাই ব্যান্ডের সদস্যরা সর্বদা চেষ্টা করে দেশীয় আয়োজনে যোগ দিতে। সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)-এর প্রতিষ্ঠান ইয়াং বাংলার নিয়মিত আয়োজন ‘জয় বাংলা কনসার্ট’-এ নিয়মিত স্টেজ মাতানো ব্যান্ড দল ‘শূন্য’। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ ভাষণের স্মরণে এ বছর ভার্চুয়াল কনসার্টেও ডাক পায় শূন্য। জয় বাংলা কনসার্ট থিম অনুযায়ী তাদের একটি গানও প্রকাশিত হয় সেদিন। ফিরে দেখা হয় দীর্ঘ ১৫ বছরের যাত্রা।

আর যে কথাটি না বললেই নয়। বেহুলা-লখীন্দরের কাহিনী তো সবাই জানি। প্রাচীন আমলের পৌরাণিক চরিত্র বেহুলা আর লখীন্দর। এ বছর বেহুলা-লখীন্দর থিমের ‘ও বেহুলা’ গানটি নতুনভাবে প্রকাশ করে ক্রিয়েটিভ ব্যান্ড শূন্য। গানটি দর্শক-শ্রোতার থেকে দারুণ সাড়া পেয়েছে। মাত্র চার মাস আগে শূন্য ব্যান্ডের অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে রিলিজ হওয়া গানটির ভিউ এখন ২১+ মিলিয়ন। লিড গিটারিস্ট শাকের রাজার প্রযোজনায় গানের লিরিক্স লিখেছেন তানভীর চৌধুরী। গানটি এত জনপ্রিয় হওয়ার কারণ অ্যানিমেশনের কারিশমা। যার কারিগর হলেন কার্টুনিস্ট অন্তিক মাহমুদ।

বেহুলা গানের পাশাপাশি অ্যানিমেটেড ‘বিবিয়া’ গানটিও সাড়া ফেলেছে বেশ। যেটি রিলিজ হয় সাত মাস আগে। শূন্য ব্যান্ডের অন্যান্য জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে বেদনা, স্মৃতির ছেঁড়া পাতা, ঝড়িয়ে দাও, রাজাহীন রাজ্য, ভাগো, শত আশা, স্বাধীনতার প্রান্তরে, প্রিয় মা অন্যতম।
১৫ বছর আগে আড্ডার মাধ্যমে গড়ে ওঠা সেদিনের ব্যান্ড শূন্য, আজ যেন পরিপূর্ণ। হাঁটি হাঁটি পা পা করে বেড়ে ওঠা বাংলার মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির টপ ব্যান্ডগুলোর অন্যতম আজকের শূন্য। নানা বাধা, ঘাটতি, সমস্যা পেরিয়ে আজ সুরের সাধনার পরিচায়ক পপ আর রক ঘরানার শূন্য।
Feature Image Courtesy: dhakatribune.com
References:
১. bdnews24.com
২. ittefaq.com.bd
৩. samakal.com
৪. kishoralo.com
৫. kalerkantho.com