২০০০ সাল, হঠাৎ করেই যেন একগুচ্ছ কালো মেঘ এসে জমা হলো ভারতীয় ক্রিকেটের আকাশে। আচমকা বজ্রপাতের আওয়াজ শুনে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া পথিকের মতোই হয়ত সেদিন অবস্থা হয়েছিল লক্ষ্য কোটি ভারতীয় ক্রিকেট প্রেমীর। ম্যাচ পাতানোর অভিযোগে ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হন তারকা ক্রিকেটার মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন, অজয় জাদেজাসহ বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার। এক তো, শচীন টেন্ডুলকারের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খুব একটা ভালো সময় যাচ্ছিল না ভারতীয় দলের। তার মধ্যে এই ম্যাচ ফিক্সিং বিতর্ক যেন মরার ওপর খারার ঘা হয়ে উঠেছিল ভারতীয় ক্রিকেটের উপর। এমন সময়ই, দলের হাল ধরেছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। এরপরের গল্প হয়ত সবারই জানা। কিন্তু, দাদা একদিনেই এই গল্পের নায়ক বনে যাননি। তাকেও পারি দিতে হয়েছে বহু কন্টকাকীর্ণ পথ।
প্রিন্স অব কলকাতা খ্যাত সৌরভ গাঙ্গুলি ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের গতিপথের পরিবর্তক। তিনি শুধু পুরো ভারতীয় দলে বিশ্বের সেরা দল হওয়ার আত্মবিশ্বাসের সঞ্চারই করে দেননি বরং, তিনি ভারতীয় দলে এমন অনেক ভবিষ্যৎ তারকা ক্রিকেটার রেখে গিয়েছিলেন যাদের হাত ধরে ভারত পরবর্তীতে অর্জন করেছিল বিশ্বসেরা হওয়ার গৌরব।
১৯৭২ সালের ৮ই জুলাই কলকতার বেহালার এক রাজকীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ক্রিকেটের মহারাজা খ্যাত সৌরভ গাঙ্গুলি। ছোট বেলা থেকে ফুটবলের প্রতি আকর্ষণ থাকলেও নিজ বড় ভাইয়ের পরামর্শে ক্রিকেট খেলা শুরু করেন এবং ক্রিকেটের সাথে নিজের সখ্যতা গড়ে উঠলে তিনি নিজেকে একজন ক্রিকেটার হিসেব প্রতিষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সৌরভ গাঙ্গুলির অভিষেক হয় ১৯৯২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচের মাধ্যমে। সেই ম্যাচে মাত্র ৩ রান করে সাজঘরে ফেরেন সৌরভ। অভিষেক ম্যাচে তেমন চমকপ্রদ পারফর্ম্যান্স না করার পর দল থেকে নিজের জায়গা হারান সৌরভ। কিন্তু ঘরোয়া লিগে দারুণ ফর্মের সুবাদে ১৯৯৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নিজের টেস্ট অভিষেকের মাধ্যমে নিজেকে প্রমাণ করার আরেকটি সুযোগ পান দাদা। সেই ম্যাচে নিজের দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিংয়ের মাধ্যমে অভিষেক টেস্টেই নিজের প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি। কিন্তু তার খেলা বেশিরভাগ শট অফ সাইড কেন্দ্রিক হওয়াতে এক প্রকার টেস্ট ব্যাটসম্যান এর তকমা পেয়ে যান তিনি।
১৯৯৭ সালে সাহারা কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে তিনি ৭৫ রানের একটি ম্যাচ জয়ী ইনিংস খেলেন। একই ম্যাচে তিনি মাত্র ১৬ রান দিয়ে ৫টি উইকেটও নিজের নামে করেন এবং সেই সুবাদে ম্যাচ সেরার পুরষ্কারও পান তিনি। একই টুর্নামেন্টে অসাধারণ প্রদর্শনের কারণে তিনি আরও ৪টি ম্যাচ সেরার পুরষ্কার লাভ করেন এবং একই সাথে তিনি টুর্নামেন্ট সেরার পুরষ্কার লাভ করলে ওয়ানডে দলেও তার জায়গা পাকাপোক্ত হয়ে যায়।
এরপরেই একের পর এক দারুণ পারফর্মেন্সের কারণে সৌরভকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি এবং সেই একই বছর তিনি ওয়ানডে ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রান করেন। ১৯৯৯ ওয়ার্ল্ড কাপে সৌরভ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৮৩ রানের একটি ইনিংস খেলেন যা তার আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ।
২০০০ সালে যখন ম্যাচ ফিক্সিং ঝড়ে উড়ে যাচ্ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের সুনাম এবং ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার শচীন যখন ব্যাটিংয়ে মনোযোগ দেয়ার জন্য নিজ দায়িত্বে অধিনায়কত্ব ছাড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, ঠিক তখনই ভারতীয় ক্রিকেট দলের নেতৃত্ব কাঁধে উঠে সৌরভ গাঙ্গুলির উপর যার ফলে উন্মোচিত হয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটে এক নতুন দিগন্ত।
যখন বিশ্ব ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের মতো মোড়লরা শাসন করছিল ঠিক তখনই বিশ্ব ক্রিকেটে এক পরিবর্তিত ভারতীয় দল দেখে ক্রিকেট বিশ্ব যাদের ক্রিকেট খেলার মূল মন্ত্রই ছিল আক্রমনাত্মক ক্রিকেট। ভারতীয় দলে সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বের অবদানে জেতা ম্যাচ গুলোর কথা বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু তার অধীনে ভারত এমন কিছু অবিশ্বাস্য জয় এবং স্মৃতি রয়েছে যা ভারতীয় ক্রিকেটকে করেছে আরো শক্তিশালী, ছুটিয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট দলে আত্মবিশাসের ফোয়ারা, উড়িয়েছে বিশ্ব ক্রিকেটে ভারতের পতাকা।
২০০১ কলকাতা টেস্ট
২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ার ভারত সফরের টেস্ট সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে কলকাতায় টস জিতে ব্যাট করতে নেমে প্রথম ইনিংসে ৪৫৭ রান সংগ্রহ করে অস্ট্রেলিয়া। জবাবে ব্যাট করতে নেমে প্রথম ইনিংসে ১৭৭ রানে অল আউট হলে ফলো অনে পড়ে ভারত। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে প্রথম উইকেটের পতন হলেই ৩ নম্বরে দাদা রাহুল দ্রাবিড়ের বদলে ব্যাট করতে পাঠান ভিভিএস লক্ষনকে। সেই ম্যাচে ভিভিএস লক্ষন ২৮০ রানের ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস খেলেন এবং সাথে রাহুল দ্রাবিড়কে নিয়ে ৩৭৬ রানের জুটি করেন যার সুবাদে ভারত তৎকালীন বিশ্বক্রিকেট শ্বাসন করা দলের বিপক্ষে ম্যাচটি জিততে সমর্থ হয়।
২০০২, হেডিংলি টেস্ট
২০০২ সালে ইংল্যান্ড সফরে যায় ভারতীয়রা। হেডিংলির পিচ সবুজ হওয়ার জন্য বিখ্যাত। এমনিতেই সুইং বোলিং সাওমালাতে বেশ ঝামেলাতেই পড়তে হতো উপমহাদেশের ব্যাটসম্যানদের, তার মধ্যে আবার সবুজ পিচ। সকলে হয়ত ধরেই নিয়েছিলেন টস জয়ী অধিনায়ক হয়ত টস জিতেই বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নিবেন। কিন্তু সেই ম্যাচের টস জিতে সকলকে চমকে দিয়ে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন দাদা। প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ৬২৮ রানে ইনিংস ঘোষণা করে ভারত। জবাবে ব্যাট করতে নেমে প্রথম ইনিংসে ২৭৩ রানে অল আউট হয়ে ফলো অনে পড়ে ইংল্যান্ড এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ড পুনরায় ব্যাট করতে নেমে ৩০৯ রানে অল আউট হলে ভারত সেই ম্যাচটি এক ইনিংস এবং ৪৬ রানে জয়লাভ করে। সেই ইনিংসে দল নির্বাচনেও সৌরভের কিছু অভিনব সিদ্ধান্ত দলকে ম্যাচ জেতাতে সাহায্য করে। তন্মধ্যে অন্যতম হলো পেস সহায়ক উইকেটে ২ জন স্পিনার নিয়ে দল সাজানো এবং সেই ম্যাচে স্পিনাররা দুই ইনিংসে মিলিয়ে প্রতিপক্ষের মোট ১১ ব্যাটসম্যানকে আউট করে। সেই ম্যাচ জয়ের সুবাদে ভারত সেই টেস্ট সিরিজ ১-১ সমতা রেখে শেষ করতে সমর্থ হয়।
২০০২, ন্যাটয়েস্ট সিরিজ এবং দাদার রাজকীয় উদযাপন
ইংল্যান্ডের মাটিতে ২০০২ সালে ত্রিদেশীয় ন্যাটওয়েস্ট সিরিজের ফাইনালে স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে হারিয়ে এক নাটকীয় জয় পায় টিম ইন্ডিয়া। সেই ম্যাচে টস জিতে ব্যাট করতে নেমে মার্কাস ট্রেসকটিক এবং ইংলিশ অধিনায়ক নাসির হোসেনের সেঞ্চুরিতে ৩২৫ রানের এক বিশাল সংগ্রহ পায় ইংল্যান্ড। ৩২৬ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে সৌরভ এবং শেবাগের মারকুটে ব্যাটিংয়ে শুরুটা ভালোই হয় ভারতের। কিন্তু এরপরই শুরু হয় ছন্দপতন। ৪৩ বলে ৬০ রান করে সৌরভ সাজঘরে ফিরেন, তখন দলীয় স্কোর ছিল ১০৬ রানে ১ উইকেট। এরপর একের পর এক ব্যাটসম্যানের আসা যাওয়ার মিছিলে দলীয় ১৪৬ রানের মাথায় ৫ উইকেট খুইয়ে তুমুল ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়লে জয়ের বন্দরে পৌঁছানো এক প্রকার অসম্ভবই মনে হচ্ছিল ভারতের জন্য। কিন্তু যুবরাজ সিং এবং মোহাম্মদ কায়েফের আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে ভর করে এক প্রকার অসাধ্য সাধন করেই ইংল্যান্ডের কাছ থেকে জয় ছিনিয়ে আনতে সমর্থ হয় সৌরভ গাঙ্গুলির দল। এরপরই সাজঘরে দাড়িয়ে নিজের শার্ট খুলে সেই দৃষ্টিনন্দন উদযাপনটি করেন।
সেই ঐতিহাসিক ফাইনাল জেতার পর সৌরভের জার্সি খুলে সেই অবিস্মরণীয় উদযাপন হয়ত কোনো ক্রিকেটপ্রেমীরই ভুলে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু সৌরভের সেই রাজকীয় উদযাপনের পেছনেও এক বড় কারণ ছিল যার সুত্রপাত ঘটেছিল ২০০২ সালের জানুয়ারিতে, ইংল্যান্ড দলের ভারত সফরের সময়। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৬ ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচের শেষ ওভারে ভারতের প্রয়োজন ছিল ১১ রান এবং হাতে ছিল ২ উইকেট। কিন্তু এন্ড্রু ফ্লিনটফের দুর্দান্ত শেষ ওভারের সুবাদে সেই ম্যাচটি জিতে নেয় ইংল্যান্ড। সেই ম্যাচে জ্যাভাগাল শ্রীনাথকে বোল্ড করে ভারত অল আউট হলে ইংল্যান্ড ম্যাচ জেতার সাথে সাথে নিজের জার্সি খুলেন ফ্লিনটফ এবং ভারতীয় সমর্থকদের দিকে ফিরে নিজ জার্সি ঘুরিয়ে এক বুনো উল্লাসে মেতে উঠেন। ফ্লিনটফের সেই সেলিব্রেশনের দৃশ্য হয়ত দাদার একটু বেশিই খারাপ লেগেছিল। তাইতো ভারতের সেই ফাইনাল জেতার পর অত্মতৃপ্তির আনন্দতা পূর্ণতা পেয়েছিল বাংলার বাঘের সেই রাজাসুলভ উদযাপনের মধ্য দিয়েই। ২০০২ সালে ভারতের সেই ন্যাটওয়েস্ট সিরিজ চ্যাম্পিয়ন হওয়াটাই বিশ্ব ক্রিকেটে ভারতকে এক নতুন ভারত হিসেবে চিনিয়েছিল।
২০০৩, অ্যাডিলেড টেস্ট
১৯৯৯-২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়া দলের রুদ্ররূপ এবং বিশ্ব ক্রিকেটে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যের কথা হয়ত কারোই ভুলে যাওয়ার কথা নয়। বাঘের মুখ থেকে খাবার ছিনিয়ে আনা যেমন অনেকটাই অসম্ভব ব্যাপার, ঠিক তেমনই অসম্ভব ব্যাপার ছিল অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে গিয়ে তাদের টেস্ট ম্যাচ হারানো। কিন্তু সৌরভের দল ঠিক তেমনই এক অসাধ্য সাধন করেছিল ২০০৩ সালের গ্যাবা টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়লাভ করে। টস জিতে ব্যাট করতে নেমে প্রথম ইনিংসে রিকি পন্টিংয়ের ২৪৩ রানের এক অসাধারন সেঞ্চুরিতে ৫৫৬ রানের বিশাল পুঁজি পায় অজিরা।
জবাবে ব্যাট করতে নেমে নিজেদের প্রথম ইনিংসে দ্রাবিড় এবং লক্ষণের ৩০৩ রানের এক মহাকাব্যিক পার্টনারশিপে ভর করে ৫২৩ রানে থামে ভারতের ইনিংস। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে অজিত আগারকারের বোলিং নৈপুণ্যে ১৯৬ রানেই গুটিয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। ২৩৩ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে রাহুল দ্রাবিড়ের ৭২ রানের ইনিংসের সুবাদে ৪ উইকেট হাতে রেখেই জয়ের বন্দরে পৌছায় ভারত।
২০০২, আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি
২০০২ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মাধ্যমে সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বে প্রথম কোনো বৈশ্বিক আসরের ফাইনাল খেলে ভারত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই আসরের ফাইনালে বৃষ্টি বাধা দিলে দুই ফাইনালিস্ট ভারত এবং শ্রীলঙ্কাকেই যৌথ চ্যম্পিয়ন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই টুর্নামেন্টে একের পর এক নাটকীয় ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে নিয়ে দলকে টুর্নামেন্টের ফাইনালে নিয়ে যান সৌরভ গাঙ্গুলি।
২০০৩, ক্রিকেট বিশ্বকাপ
সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বে ২০০৩ সালের আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপে ফাইনালে উঠে ভারত। কিন্তু শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেদিন আর পেরে উঠতে পারেনি সৌরভ গাঙ্গুলির দল। সেই বিশ্বকাপে ভারতীয় দল চ্যাম্পিয়ন না হতে পারলেও পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই ছিলো সৌরভবাহিনীর দাপট। তার পাশাপাশি বিশ্ব ক্রিকেটে এক নতুন পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল ভারত।
সৌরভ গাঙ্গুলি যেমন আত্মবিশ্বাসে ধুকতে থাকা ভারতীয় দলে সঞ্চার করেছিলেন জয়ী হওয়ার তীব্র আত্মবিশ্বাস এবং ঠিক তেমনি দলে তরুণ তুর্কিদের সুযোগ দিয়ে বীজ বপন করেছিলেন এমন এক ভবিষ্যৎ ভারতীয় দলের যা পরবর্তীতে ভারতীয় দলকে এনে দিয়েছিল সেরাদের সেরা হওয়ার স্বাদ। শুধু তরুণদেরই নয়, তিনি আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিলেন খারাপ ফর্মে ভুগতে থাকা বেশ কিছু পরীক্ষিত খেলোয়াড়দেরও।
১. বীরেন্দ্র শেবাগের ক্যারিয়ারে সৌরভ
বীরেন্দ্র শেবাগের এতো বর্ণাঢ্য ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ারে সবথেকে বড় অবদান ছিল সৌরভ গাঙ্গুলির। ১৯৯৯ সালে শেবাগ পাকিস্তানের বিপক্ষে নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক ওডিআই ম্যাচ খেললেও সেই ম্যাচে মাত্র ১ রান করলে দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। পরবর্তীতে সুযোগ পান ২০০১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নিজের টেস্ট অভিষেক ম্যাচে। এরপর দলে মিডেল অর্ডারে কিছু ম্যাচে ব্যাটিং করলেও, একদিন সৌরভ তাকে ওপেনিংয়ে ব্যাটিং করার প্রস্তাব দেন। তিনি সেটি লুফে নেন এবং ওপেনিং ক্যারিয়ারের চতুর্থ ম্যচেই ৭০ বলে সেঞ্চুরি করেন। শেবাগ ওপেনার হিসেবে তার ওডিআই ক্যারিয়ারে ৭৫১৮ রান করেন এবং টেস্ট ক্যারিয়ারে ৮২০৭ রান করেন।
২. যুবরাজ সিং এর ক্যারিয়ারে সৌরভ
সৌরভ সর্বদাই চেয়েছিলেন যেন তার দল নির্ভীক ক্রিকেট খেলুক। তার অধিনায়কত্বে দলে সুযোগ পাওয়া আরেক সুপারস্টার হলেন যুবরাজ সিং। এই যুবরাজ সিংই ভারত দলকে ২০০৭ টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং ২০১১ বিশ্বকাপ জেতাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন
৩. মহেন্দ্র সিং ধনীর ক্যারিয়ারে সৌরভ
সৌরভ গাঙ্গুলির অধীনেই অভিষেক ঘটে ভারতের সর্বকালের সফল অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধনীর। বাংলাদেশের বিপক্ষে অভিষেক সিরিজে তেমন পারফর্মেন্স না দেখাতে পারলেও সৌরভ তাকে পাকিস্তানের বিপক্ষে পরের সিরিজেও সুযোগ প্রদান করেন এবং ধোনীও সৌরভের আস্থার প্রতিদান দিয়েছিলেন। সেই সিরিজের প্রথম ম্যাচেও ধোনী বেশি রান না করতে পারলেও সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে তাকে তিন নম্বর পজিশনে ব্যাট করতে পাঠান দাদা। সেই ম্যাচে ১২৩ বলে ১৪৮ রান করে বিশ্ব ক্রিকেটে নিজের আগমনী বার্তা দেন ধোনী। পরবর্তীতে ধোনীর নেতৃত্বেই ভারত তিনটি বৈশ্বিক আসরের শিরোপা লাভ করে। অথচ ধোনির ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে সৌরভ আস্থা না রাখলে বয়ে যাওয়া মেঘের মতোই হারিয়ে যেতে পারতেন ধোনি
৪. ইরফান পাঠান ক্যারিয়ারে সৌরভ
ইরফান পাঠান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন ২০০৩ সালে সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বে। দাদার নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বেশ ভালো সময়ই কাটিয়েছেন তিনি। সৌরভ গাঙ্গুলি তাকে পূর্ণরূপে প্রস্ফুটিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট সুযোগ দিয়েছিলেন যার কারণে খুব অল্প সময়েই ভারতীয় দলের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেন ইরফান। তিনি ২০০৭ আইসিসি ওয়ার্ল্ড টি টুয়েন্টির ম্যান অফ দ্যা ফাইনাল ছিলেন। তাকে এক সাক্ষাৎকারে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ অধিনায়ক কে, তা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি সৌরভ গাঙ্গুলি কেই ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ অধিনায়ক হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
৫. জহির খান ক্যারিয়ারে সৌরভ
ভারতীয় ক্রিকেট দল যখন পেস বোলিং সংকটে ভুগছিল তখনই দলে পেস বোলিংয়ের অন্যতম কান্ডারি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন জহির খান এবং তাকে দলে সুযোগ দিতে এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। ২০১১ বিশ্বকাপে এই জহির খান টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি ২১ উইকেট লাভ করেন যা ভারতকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করতে এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
সৌরভ গাঙ্গুলি এবং অনীল কুম্বলে
২০০৩ সালে চরম ফর্মহীনতায় ভুগছিলেন ভারতের অন্যতম স্পিন বোলিং লেজেন্ড অনিল কুম্বলে। তার ফর্ম এতোটাই খারাপ ছিল যে ২০০৩-০৪ এ ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফরে নির্বাচকেরা তাকে দলে না নিয়ে মুরালি কার্তিককে দলে সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সৌরভ গাঙ্গুলির একান্ত প্রচেষ্টায় সেই সিরিজে এক বিরাট শর্তের বিনিময়ে অনিল কুম্বলেকে অস্ট্রেলিয়া সফরে জায়গা দেওয়া হয়। শর্তটা এমন যে, অনিল কুম্বলে অস্ট্রেলিয়া সিরিজে ভালো পারফর্ম না করলে সৌরভকে ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু, অনিল কুম্বলে শুধু অস্ট্রেলিয়া সিরিজেই ভালো পারফর্ম করেননি বরং অস্ট্রেলিয়া সফর শেষে একই বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বাধিক ৮১টি উইকেট লাভ করে দাদার আস্থার প্রতিদান দেন।
ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ারের কালো সময় এবং রাজকীয় প্রত্যাবর্তন
সৌরভ গাঙ্গুলি ২০০০-২০০৫ পর্যন্ত অধিনায়কত্ব করে ভারতকে বিশ্বে এক মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। কিন্তু ২০০৫ সালে গ্রেগ চ্যাপেল ভারতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই নিজের ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ারে একের পর এক অধঃপতনের সম্মুখে পড়তে থাকেন। খারাপটার শুরু হয় ২০০৫ সালের জিম্বাবুয়ে সিরিজে, তখনই সৌরভের সঙ্গে গ্রেগ চ্যাপেলের অপেশাদারসুলভ আচরণের কারণে একবার নিজের ব্যাগ গুছিয়ে রাগের মাথায় সিরিজ থেকেই চলে আসতে চাইছিলেন।
২০০৫ এর অক্টোবরে ঘরের মাটিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজে ইনজুরিতে পড়েন সৌরভ। এরপর দলকে নেতৃত্বের সুযোগ দেয়া হয় রাহুল দ্রাবিড়কে। সেই সিরিজে দ্রাবিড়ের নেতৃত্বে প্রথম ৪ ম্যাচে ৪-০ এর লিড নেয় ভারত। পরের ৩ ম্যাচে সৌরভ ইনজুরি মুক্ত থাকলেও তাকে দলেই রাখা হয়নি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হোম সিরিজটি ভারত ৬-১ ব্যবধানে জয়লাভ করে।
এরপরে ঘরের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৫ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজেও দলে রাখা হয়নি তাকে। সেই সিরিজের চতুর্থ ওয়ানডে ম্যাচ ছিল কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে। সেখানে স্টেডিয়ামের বাহিরে ক্রিকেট ভক্তরা কোচ চ্যাপেলের বিরুদ্ধে লিখা বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাদাকে দলে না নেওয়ার ক্ষোভ ব্যাক্ত করতে থাকে।
সেই ম্যাচে বহু ভারতীয় দর্শক ক্ষোভে ভারতের জায়গায় দক্ষিণ আফ্রিকার সাপোর্ট করেন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা খুব সহজেই জিততে সক্ষম হয়। সিরিজটি ২-২ এ ড্র হয়। এরপরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে সৌরভ দলে জায়গা পেলে অধিনায়ক হিসেবে রাহুল দ্রাবিড়কেই দায়িত্ব দেয়া হয়। সেই সিরিজে গাঙ্গুলি বৃষ্টি বিঘ্নিত প্রথম ম্যাচে ৫ রান করেন এবং দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচে ২ ইনিংস মিলিয়ে মোট ৭৯ রান করেন। কিন্তু তৃতীয় টেস্টে তাকে আবারো দল থেকে বাদ করা হয়, যে সংবাদ শুনে সৌরভ নিজেই কেঁদে দিয়েছিলেন।
এরপরে পাকিস্তান এবং ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজেও দলে তেমন একটা সুযোগ পাননি এবং এরপরে মাসের পর মাস দল থেকে নির্বাসিত হয়েছেন এক সময়ের মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো এই কিংবদন্তী। ২০০৬ সালে ঘরের মাটিতে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি এবং দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে বেশ লজ্জাজনক ক্রিকেটের প্রদর্শন করে সৌরভবিহীন টিম ইন্ডিয়া। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে আরেকবার সুযোগ পান সৌরভ গাঙ্গুলি। সেই সিরিজের প্রথম টেস্ট ম্যাচে সৌরভ একটি অর্ধশতক করেন, যা ভারতকে ম্যাচটি জিততে সাহায্য করে। এরপর সৌরভকে ২০০৭ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে পুনরায় ওয়ানডে দলে জায়গা দেয়া হয় এবং সেই সিরিজের প্রথম ম্যাচেই ৯৮ রান করে ম্যান অব দ্যা ম্যাচ নির্বাচিত হন তিনি। এরপরে শ্রীলঙ্কা সিরিজে আবারো নিজের দারূণ পারফর্মেন্সের প্রদর্শন করেন। সেই সিরিজে দাদা ম্যান অব দ্যা সিরিজ নির্বাচিত হন।
২০০৭ বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়ে ভারত। কিন্তু ভারত হারলেও সৌরভের ব্যাট কিন্তু তবুও চলছিল। বাংলাদেশের বিপক্ষে ভারতের সেই হারা ম্যাচটিতেও ভারতের পক্ষে সর্বাধিক রান করেন তিনি। সৌরভ ২০০৭ এ টেস্ট ক্রিকেটে ৬১.৪৪ গড়ে সেই বছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১০৪ রান করেন যার মধ্যে পাকিস্তানের বিপক্ষে একটি ডাবল সেঞ্চুরিও রয়েছে এবং একই সাথে ওয়ানডেতেও ৪৪.২৮ গড়ে ১২৪০ রান করেন।
২০০৮ সালে নিজেদের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের মাধ্যমে নিজের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ করেন। সেই সিরিজটি ভারত ২-০ তে জয়লাভ করে এবং যে ২ ম্যাচে ভারত জয়লাভ করে তার প্রত্যেকটির একটির প্রথম ইনিংসে সৌরভ সেঞ্চুরি করেন এবং পরেরটির প্রথম ইনিংসে সৌরভ ৮৫ রান করে দলকে সিরিজ জিততে সাহায্য করেন। এরপর তিনি ২০১২ পর্যন্ত আইপিএল খেলে নিজের খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করেন। বর্তমানে তিনি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই ) এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োজিত আছেন।
সৌরভ গাঙ্গুলি তার টেস্ট ক্যারিয়ারে ১১৩ ম্যাচ খেলে ৪২.১৮ গড়ে ১৬টি সেঞ্চুরি এবং ৩৫টি ফিফটিসহ ৭২১২ রান করেন এবং ওয়ানডেতে ৩১১টি ম্যাচ খেলে ৪০.৭৩ গড়ে ১১৩৬৩ রান করেন, যেখানে সেঞ্চুরি ছিল ২২টি এবং ফিফটি ছিল ৭২ টি।
হোচট খেয়ে পুনরায় উঠে দাড়ানোর নামই জীবন। হারার পর পুনরায় জেতার তীব্র ইচ্ছা নিয়ে জিতে দেখানোর নামই জীবন। সৌরভ গাঙ্গুলি তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং নিজের কঠিন সময়েও ধৈর্য ধরে একাধিক বার হোচট খেয়েও যেভাবে পূর্বের চেয়ে ভয়ানকভাবে উঠে দাড়ানোর স্পর্ধা দেখিয়েছেন, তা জীবনের এই সংজ্ঞাগুলোকেই নির্দেশ করে। তাই তো নজরুল বলেছেন, “বল বীর চির-উন্নত মম শির!” হয়ত, নজরুল তার কবিতাতে সৌরভের মতো এমন আত্মপ্রত্যয়ী মানুষদেরই কথা বলেছেন যারা শত কঠিন সময়েও জীবন রণক্ষেত্রে পরিস্থিতির সাথে চোখে চোখ মিলিয়ে বীরের মতো লড়ে যায়। শুধুমাত্র ক্রিকেটেই নয় বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রতিকূলতা মোকাবেলায় সৌরভের মতো এমন যোদ্ধারাই মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
Feature Image Courtesy: pinterest.com