আত্মোন্নয়ন ও উন্নত

দর্শন হলো অস্তিত্ব, জ্ঞান, মূল্যবোধ, যুক্তি, মন ও ভাষা সম্পর্কে সাধারণ এবং মৌলিক প্রশ্নগুলোর অধ্যয়ন। আর এসব সাধারণ ও মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে উদ্ভব হয়েছে বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদের। তেমনি একটি দার্শনিক মতবাদ হলো স্টোয়িসিজম বা স্টোয়িকবাদ। এটি মূলত একটি ব্যবহারিক দার্শনিক মতবাদ। যে কেউ চাইলে স্টোয়িক দর্শন চর্চার মাধ্যমে যুক্তিযুক্ত চিন্তা কে কাজে লাগিয়ে আত্মশুদ্ধি, সুন্দর-সুখী ও সততার সাথে জীবন পরিচালনা করতে পারে।

স্টোয়িক দর্শন কী?

স্টোয়িক দর্শন বা স্টোয়িকবাদ সাধারণত ধ্বংসাত্মক আবেগ কে কাটিয়ে ওঠার উপায় হিসেবে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ ও ধৈর্য্যের শিক্ষা দেয় যেখানে নৈতিকতা ও নৈতিক কল্যাণ প্রাথমিকভাবে জড়িত। অর্থাৎ এই মতবাদ অনুসারে মানুষের সুখী জীবন নির্ভর করে তার মানসিক দক্ষতার উপর, যে সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ আবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে নিরপেক্ষভাবে একটা ঘটনাকে এমনভাবে প্রত্যক্ষ করবে যাতে সে উক্ত ঘটনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়।

সংক্ষেপে স্টোয়িক দর্শন; Image Courtesy: audible.com

স্টোয়িক দর্শনের উৎপত্তি ও বিকাশ

গ্রীক দার্শনিক সিটিয়ামের জেনো (৩৩৪ খ্রিঃপূর্ব – ২৬২ অব্দ) এর হাত ধরে স্টোয়িক দর্শনের উৎপত্তি। সিটিয়ামের ‘স্টোয়া পয়কিলে’ নামক খোলা এক আর্ট গ্যালারিতে সর্বপ্রথম এই দর্শন প্রচারিত হয়। এই ‘স্টোয়া’ থেকেই নামকরন হয় স্টোয়িসিজম। পরবর্তীতে স্পেনীয় দার্শনিক সেনেকা (৪ খ্রিঃপূর্ব – ৬৫ অব্দ), শুরুর জীবনে দাস পরে দার্শনিক এবং শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ এপিকটেটাস (৫৫ – ১৩৫ খ্রিস্টাব্দ) ও মহান রোমান সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস (১২১ – ১৮০ সাল) প্রমুখের মাধ্যমে এই দর্শন বিকাশ লাভ করে।

‘স্টোয়া পয়কিলে’, যেখান থেকে প্রথম স্টোয়িক দর্শন প্রচারিত হয়; Image Courtesy: agoraacsa.net

স্টোয়িক দর্শনের মূল ভাবনা

আমরা আগেই জেনেছি স্টোয়িকবাদ দর্শনের অন্যান্য তাত্বিক মতবাদের বাইরে একটি ব্যবহারিক দার্শনিক মতবাদ, যা বাস্তব জীবনে প্রয়োগের বিষয়।
স্টোয়িক দর্শন প্রধানত;

(ক) কোন বিষয়গুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণে আর কোন গুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে অর্থাৎ ইচ্ছাশক্তির আত্মনিয়ন্ত্রণ অর্জন

(খ) আমাদের চারপাশ সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে

মূলত এই দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।

স্টোয়িকবাদ অনুযায়ী, কোন বিষয়গুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে, কোন বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে তা অনুধাবন করা খুব জরুরি। মানুষ তার নিয়ন্ত্রণের বাইরের বিষয়গুলো নিয়ে দুশ্চিন্তা ও হতাশায় ভোগে বেশি। যেমন, একজন মানুষ কোন পরিবারে জন্ম নিবে, কেমন পরিবেশে সে বেড়ে উঠবে সেটা নির্বাচনের সুযোগ তার থাকে না। এখন যদি সে সেই পরিবার বা পরিবেশের কারণে অসৎ চরিত্রের অধিকারী হয় তাহলে একটা সময় সে তার ভাগ্যকে দোষারোপ করতে পারে। কিন্তু স্টোয়িকবাদ বলবে এটা আপনাকে মেনে নিতে কারণ ভাগ্য ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বরং বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে যা আছে তার সর্বোচ্চ ব্যবহারে মনোযোগী হলে তাতে সন্তুষ্টি খুঁজে পাওয়া যাবে।

স্টোয়িক দর্শন সম্পর্কিত বই; Image Courtesy: dailystoic.com

দ্বিতীয়ত, একটা ঘটনা ভালো নাকি মন্দ সেটা নির্ভর করে আসলে আমাদের জাজমেন্টাল দৃষ্টিভঙ্গির উপর। দেখা গেলো, একই ঘটনা কারো কাছে ভালো আবার কারো কাছে খারাপ। এ থেকে বোঝা যায় যে, বাহ্যিক কোনো ঘটনা নয় বরং সেই বিষয় সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কি তার উপরই নির্ভর করে সবকিছু। এখানে স্টোয়িকবাদ বলবে দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে ইতিবাচক হন, এতে আপনিই লাভবান হবেন যা আপনার জন্য এনে দিতে পারে সুখ।

তাছাড়া একজন ব্যক্তি এই দর্শন চর্চার মাধ্যমে কোনো কাজ বা সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আমাদের ভাবনা কী হবে তা বুঝতে সক্ষম হবে। মানুষের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার বিচারবোধ। স্টোয়িকবাদ ব্যক্তির বিচারবোধকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে বলে। এতে করে যেকোনো কাজে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হয়ে যায়।

কয়েকজন স্টোয়িক দার্শনিকের মতামত

চলুন এবার জেনে নেওয়া যাক কয়েকজন স্টোয়িক দার্শনিকের মতামত,

১.

“ব্যর্থতা হচ্ছে স্বাভাবিক, আক্ষেপ হলো নিরর্থক” – মার্কাস অরেলিয়াস
অর্থাৎ, কখনো ব্যর্থতা নিয়ে আক্ষেপ করা যাবে না বরং ব্যর্থতা কিভাবে কাটিয়ে সফলতা অর্জন করা যায় সেটা নিয়েই ভাবতে হবে।

মহান রোমান সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস; Image Courtesy: Britannica.com

২.

“তিনি একজন প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তি, যা তাঁর কাছে নেই তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন না, তবে যা আছে তা নিয়ে তিনি আনন্দিত”– এপিকটেটাস

আমাদের যা আছে তা নিয়ে সবসময় সন্তুষ্ট থাকতে হবে, যা আমাদের নেই তা নিয়ে মন খারাপ করে সময় নষ্ট করা যাবে না।

দার্শনিক এপিকটেটাস; Image Courtesy: idler.co.uk

৩.

“মঙ্গল সাধিত হয় ছোটোর সাথে ছোটো জোড়া লেগেই। তাই কোনো কিছুই আদতে ‘ছোটো’ নয়” – জেনো

জেনো এর মাধ্যমে আমাদের কোনো কিছুকেই ছোট বলে আক্ষেপ করতে নিষেধ করেছেন। ছোটো ছোটো কাজের মাধ্যমেই বড় কাজের মাহাত্ম্য ফুটে উঠে।

গ্রীক দার্শনিক সিটিয়ামের জেনো যার হাত ধরে প্রথম স্টোয়িক দর্শন প্রচারিত হয়; Image Courtesy: bbc.com

বাস্তব জীবনে স্টোয়িক দর্শনের ব্যবহার

এখন কেউ যদি স্টোয়িক দর্শন চর্চার মাধ্যমে আত্মোন্নয়ন ও সুখী জীবনযাপন করতে চায় অবশ্যই প্রথমে তার নিজের চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন আনতে হবে এবং বাস্তবতাকে মানতে শিখতে হবে। চাইলেই একদিনেই কেউ এর সুফল ভোগ করতে পারবেনা, তাই স্টোয়িক দর্শন থেকে অর্জিত শিক্ষা নিয়মিত প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার করতে হবে। এর পাশাপাশি একটি ভার্চুয়াস লাইফ লিড করতে হবে। এই দর্শন শুধু ব্যক্তির উপলব্ধিবোধ জাগানোতেই শেষ নয়, এর পাশাপাশি একটি নৈতিক জীবন লিড করার পক্ষে ও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিয়ে থাকে। তবেই একজন উন্নত ও প্রকৃত সুখী জীবনযাপন করতে পারবে বলে আশা করা যায়।

জীবনকে উপভোগ করার জন্য স্টোয়িক দর্শন সম্পর্কে জানতে হবে; Image Courtesy: medium.com

শেষ কথা

অনেকে স্টোয়িসিজমকে আবেগহীনতা বলে মনে করতে পারেন। আসলে তা নয় বরং আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে কীভাবে একটা সুন্দর জীবন উপভোগ করা যায় তাই হচ্ছে স্টোয়িসিজমের মূল শিক্ষা। তাই যে কেউ চাইলেই এই স্টোয়িক দর্শন নিয়ে পড়তে পারেন, জানতে পারেন। আশা করি, আপনার জীবনে চলার পথে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতে এই দর্শন সাহায্য করবে।

Feature Image Courtesy: TED-Ed