Nausicaä of the Valley of the Wind এর অপ্রত্যাশিত সাফল্যের পর দুই বন্ধু এবং দীর্ঘদিনের কলিগ, হায়াও মিয়াজাকি আর ইসাও তাকাহাতা, প্রযোজক তোশিও সুজুকির সাথে মিলে এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা করলেন যা অ্যানিমেশনের সংজ্ঞাকেই পাল্টে দেবে। ১৯৮৫ সালের ১৫ জুন নির্মাণ করলেন স্টুডিও জিবলি (জিবুরি)। জিবলি/জিবুরি নামটি এসেছে ২য় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত ইতালীয় বিমান Caproni Ca.309 Ghibli থেকে।
এর পরের তিন দশক ধরে এই স্টুডিওটি এমন কিছু ছবি নির্মাণ করেছে যা শুধু জাপানেই নয়; বরং বহির্বিশ্বেও সমালোচকদের ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে। একইসাথে ব্যবসাসফলও ছিল অধিকাংশ ছবি। তন্মধ্যে কিছু ছবি যে বছর মুক্তি পেয়েছে, সে বছর বক্স অফিসে নাম্বার ওয়ান হিট হিসেবেও ছিল।
এর জনপ্রিয়তা শুধু জাপানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং জাপানের বাইরে সারা বিশ্বের অ্যানিমেটর আর লাইভ-অ্যাকশন চলচ্চিত্রকারদেরও অনুপ্রাণিত করেছে।

আধুনিক কালের চলচ্চিত্র নির্মাণের ধারাকে পাল্টে দিয়েছে জিবলির গল্পকথন। এতে কোনো দ্বিধা নেই। জিবলির ছবি শুধু বাচ্চাদের জন্য বললেও ভুল বলা হবে। কারণ প্রাপ্তবয়স্করাও এতে নিজেদের খুঁজে পাবেন, কখনো কখনো অপ্রত্যাশিতভাবেই। মাত্র তিন দশকের মধ্যেই জিবলি এক ডজন মাস্টারপিস উপহার দিয়েছে।
২০১৪ সালের পর থেকে জিবলি থেকে আর কোনো ছবি মুক্তি পায়নি। তবে গুঞ্জন আছে জিবলি খুব দ্রুতই ফিরে আসবে ‘How Do You Live’ ছবি দিয়ে। চলুন, ২য় পর্বে সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক জিবলির আরো ১১টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সম্পর্কে।
Castle in the Sky (1986)
স্টুডিও জিবলির প্রথম অফিশিয়াল এই ছবিটিতে পাজু মাইনে কাজ করে। আকাশ থেকে রহস্যজনকভাবে পড়ার সময় শিতাকে বাঁচানোর মাধ্যমে তাদের পরিচয় হয়। দু’জনই এক কিংবদন্তির খোঁজে আছে৷ আর তা হলো লাপুতা, আকাশে থাকা প্রাসাদ।
অদ্ভুত যে ব্যাপারটি তা হলো হায়াও মিয়াজাকি কীভাবে আমাদের পক্ষপাত বা পূর্বধারণাকে দুমড়ে-মুচড়ে দেন। একটি দৃশ্যের কথা বলা যেতে পারে। দানবাকৃতির রোবটগুলোকে দেখার পর প্রথমেই মনে হবে এগুলো শুধু ধ্বংসই করতে জানে। কিন্তু মিয়াজাকি তা করেননি। বরং এদের ভালো বৈশিষ্ট্যকেও তুলে আনেন। আবার বৃদ্ধদের সম্পর্কে অনেকের স্টেরিওটাইপ যে তারা নিষ্ক্রিয় কিংবা অ্যাকশনে প্রায়ই অনুপস্থিত, সেই ধারণাও তিনি ভেঙে চুরমার করে দেন যখন আমরা ডোলাকে দেখতে পাই। ডোলাকে প্রথমে ভিলেন মনে হলেও, তার মমতাময়ী অংশটাও পরে চোখে পড়ে। মিয়াজাকির সবচেয়ে বিখ্যাত চরিত্রের মধ্যে মাদার ডোলা একটি।
ছবিটি জাপানের বাইরে বিশেষভাবে জনপ্রিয়। শক্তিশালী একটি গল্প, কিছু স্মরণীয় চরিত্র আর রোমাঞ্চকর অভিযানের মতো বিষয়বস্তুর জন্য জিবলির প্রথম মাস্টারপিস বলা যায় একে। সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। জো হিসাইশির করা সুর এখনো অতটাই জনপ্রিয়। এই ছবির মাধ্যমে জিবলি দর্শকের কাছ থেকে আস্থার জায়গাটা আদায় করে নেয়। তবে এর ব্যবসায়িক সাফল্য স্বল্পই ছিল, তাই জিবলিকে এরপরও বাইরের ফান্ডিংয়ের উপর নির্ভর করতে হয়েছে।
ছবিটিতে কিছু এমন এলিমেন্ট ছিল যা পরে বারবার বাকি ছবিগুলোতে এসেছে। শুধু জিবলিই না, বরং পিক্সারের গতিপথকেও অনেক বেশি প্রভাবিত করেছে।
১৯৮৪ সালে মিয়াজাকির দেখা ওয়েলশ মাইনারদের দ্বারা পাজুর চরিত্রটি অনুপ্রাণিত। লোভ-লালসা, সাহস, আত্মত্যাগ এবং শিল্পায়নের মতো বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে ছবিতে। পরের জিবলি মুভিগুলোর মতো জটিলতা না থাকলেও, মিয়াজাকির ছবিটি দেখতে খারাপ লাগবে না।

Graves of the Fireflies (1988)
১৯৬৭ সালে আকিয়ুকি নোসাকার লেখা আত্মজীবনীমূলক ‘গ্রেভ অভ দ্য ফায়ারফ্লাইস’ এ উঠে এসেছে ২য় বিশ্বযুদ্ধে তাঁর দুই বোনকে হারানোর বেদনা, আক্ষেপের মতো বিষয়বস্তু। বইটির প্রকাশকই জিবলিকে ছবিটি প্রস্তুত করার জন্য স্পন্সর করেছিলো। ইসাও তাকাহাতা তা পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন সুন্দর, বেদনাবিধুরভাবে। এটি যুদ্ধ নিয়ে কোনো ছবি না। বরং যুদ্ধ মানুষের জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করে, যুদ্ধের পরিণাম কেমন হয় তা-ই দুই ভাই-বোনের হৃদয় নিংড়ানো যাত্রা দিয়ে দেখানো হয়েছে।
ছবির প্রতি চরিত্রেরই আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো ভুল-ভ্রান্তি আছে। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সেইতাও সেরকমই। সে তার বোনের ব্যাপারে অনেক যত্নশীল হলেও, অপরিণামদর্শী, প্রতিক্রিয়াশীল এক কিশোর। তা-ই দিনশেষে ছবিটা অনেক বেশি মানবিকই বটে।
অনেকটা বিলি ওয়াইল্ডারের হলিউড ক্লাসিক ‘সানসেট বুলেভার্ড’ (১৯৫০) এর মতো সেইতার মৃতদেহের আত্মার দৃষ্টিকোণ থেকে এর গল্পটি দেখানো হয়েছে।
সেইতার বাবা নৌবাহিনীতে কাজ করলেও ছবিটি সৈনিকদের নিয়ে না। ছবিটি বরং সাধারণ মানুষদের নিয়ে যাদের যুদ্ধ সম্পর্কে ধারণা শূন্যের কোঠায়। কিন্তু যুদ্ধে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে৷ ছবিটিতে পুরো জাপানের তৎকালীন পরিস্থিতিকে ক্ষুদ্র কলেবরে, কোবের মানুষদের দিয়ে দেখানো হয়েছে।
২য় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে জাপান। মিত্রবাহিনীর বোমাবর্ষণে স্রেফ হিরোশিমা আর নাগাসাকিই নয়, টোকিও, কোবের মতো শহরগুলোও বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে। সেই কোবে শহরেই দুই ভাইবোন, কিশোর সেইতা আর সেতসুকো। ছবির শুরুর দিকে তারা তাদের মা’কে হারায়। সেইতার সামনেই তার মা মারা যায়।
জরুরি সময়ের জন্য মাটির নিচে পুঁতে রাখা খাবার, আনুষঙ্গিক জিনিস নিয়ে নিশিনোমিয়াতে থাকা খালার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ছবির ঘটনাপ্রবাহেই নয়, রূপক হিসেবেও জোনাকি পোকাকে ব্যবহার করেছেন তাকাহাতা। সেতসুকোর আশাবাদী আর হাস্যোজ্জ্বল মুখের আনন্দ জোনাকি পোকার মতো ক্ষণিকের, যে জ্বলজ্বল করে তীব্রভাবে কিন্তু হুট করে নিভেও যায়। এমনকি সেইসব বোমারু বিমানেরও ছোট্ট প্রতিরূপ এই জোনাকি পোকাগুলো।
এটি জিবলির অন্যতম ছবি যা মূলত বাচ্চাদের জন্য না৷ পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে, কারো দিকে প্রত্যক্ষভাবে আঙ্গুল তাক না করে, স্রেফ সত্য ঘটনা দেখিয়ে দর্শককে তা ভাবায়।

দেখতে গেলে মনে হবে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রেখেই ছবিটি নিজের কার্যসমাধা করে যাচ্ছে। যুদ্ধ নিয়ে ছবিটি না হলেও, যুদ্ধবিরোধী বার্তাটি এখানে খুব স্পষ্ট – আপনি যে জাতিরই হোন না কেন।
দেড় ঘণ্টার এই ভয়ানক বাস্তবতা যেকোনো বয়সী দর্শককে মানসিকভাবে ভেঙে দিতে যথেষ্ট। কিন্তু তবু যুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পারবেন।
Porco Rosso (1992)
জাপান এয়ারলাইনস নিজেদের ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জন্য চেয়েছিল একটি ৩০-৪৫ মিনিটের শর্ট ফিল্ম বানাতে। তাই তারা স্টুডিও জিবলিকে এর প্রস্তাব দিলো। কিন্তু হায়াও মিয়াজাকি আসা মাত্রই সব পাল্টে গেল। কারণ মিয়াজাকি একে আরো স্পন্সর নিয়ে, অনেক বিস্তৃত করে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানাতে চাইলেন।
মিয়াজাকির নিজের লেখা মাঙ্গার উপরই ভিত্তি করে তিনি ছবিটি বানালেন। প্রেক্ষাপট ১৯৩০ এর দশকের ইতালি। চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র মারকো প্যাগট প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঝানু পাইলট যে কোনো কারণে অভিশপ্ত হয়ে লাল শূকর বনে গেছে। কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে একদমই স্রোতের বিপরীতের একজন।
মিয়াজাকি মারকোর নাম নিয়েছেন শার্লক হাউন্ডে তাঁর সাথে কাজ করা এক ইতালীয় অ্যানিমেটরের নাম থেকে। জিবলি নামটিও তো এসেছে ২য় বিশ্বযুদ্ধের ইতালীয় বিমান থেকে।
‘My Neighbour Totoro’ যদি মিয়াজাকির নিজের জীবনঘনিষ্ঠ হয়, তবে ‘Porco Rosso’ তাঁর সবচেয়ে ব্যক্তিগত ছবি, তাঁর স্বপ্ন ও অবসেশনের গল্প। শুধু তা-ই নয়, অ্যানিমেশনের সুদীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী ও নিরীক্ষাধর্মী অতীত নিয়েও পোর্কো রোসসো কথা বলে। তা ছবিটি দেখলেই বুঝতে পারবেন।
মিয়াজাকির বাকি ছবির মতো, এখানেও শক্তিশালী নারী চরিত্রের দেখা মেলে, যদিও তারা সংখ্যায় কম। যুদ্ধে জিনা স্বামীকে হারিয়ে ভিক্টিম হয়ে পড়েনি, বরং আরো সাহসী হয়েছে। ১৭ বছর বয়সী মেধাবী ফিও, মার্কোর সহকারী হিসেবে কাজ করে। মার্কো প্রথমে ফিওর বুদ্ধির জোরে বিশ্বাস রাখতে না পারলেও, পরে তা পাল্টায়।
“I’d rather be a pig than a fascist.” মার্কোর এ কথাটি দিয়েই বুঝা যায় সে তার দেশের দুঃশাসনকে সহ্য করতে পারে না। বরং অনেক বেশি ঘৃণা করে। তার চরিত্রটা বেশ জটিল।
ছবিটিকে বলা যেতে পারে হলিউডের ক্লাসিক অ্যাডভেঞ্চারের প্রতিরূপ। মুক্তি পাওয়া মাত্রই জাপানের বক্স অফিসের এক নাম্বার হিট ছিল এটি। হাওয়ার্ড হকস কিংবা জন হিউস্টনের ছবির মতো মনে হবে। সেকালে হাম্ফ্রি বোগার্ট হয়তো এতে অভিনয় করতে পারতেন। অ্যাকশন অ্যানিমেশনে মুনশিয়ানা দেখিয়ে মিয়াজাকি বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি কারো চেয়ে কম না। মার্কোর উড়ার দৃশ্যগুলো ‘৯০ এর দশকের জন্য অভূতপূর্ব ছিল।
আমেরিকান ডাবে কেন্দ্রীয় চরিত্রে মাইকেল কিটনের কণ্ঠ বোধহয় মার্কিন মহলে ছবিটিকে আরো জনপ্রিয় করে তুলেছে। ছবিটি এক ধরনের কাল্ট ফলোয়িং পাওয়ায় মিয়াজাকি ২০১১ সালের এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন এর সিকুয়েল বানানোর কথা। কিন্তু এখন তা আর না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি।
পুরনো এভিয়েশন বিষয়ক ছবিরও অনেক রেফারেন্স পাওয়া যাবে পোর্কো রোসসোতে। এটি সম্ভবত মিয়াজাকির গুটিকয়েক ছবির একটি যাতে আদতে পরিবেশ বিষয়ক কোনো বার্তা নেই। তবু ফ্যাসিবাদের আগ্রাসন, ১ম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইতালির অবস্থা ইত্যাদিতে আলোকপাত করেছেন মিয়াজাকি যা জিবলির আন্ডাররেটেড ক্লাসিক।

Ocean Waves (1993)
স্টুডিও জিবলিকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে টিমের তরুণ অ্যানিমেটরদের কাছ থেকে পূর্ণ-দৈর্ঘ্য ছবি তৈরিতে উৎসাহিত করা হয়েছিল। তারই হাত ধরে তরুণ সদস্য তোমোমি মোচিজুকি টেলিভিশনের জন্য নির্মাণ করেন ‘Ocean Waves।‘ জাপানে এটি ‘I Can Hear the Sea’ নামে পরিচিত। ইসাও তাকাহাতা প্রযোজক হিসেবে ছবির প্রোডাকশনের দেখভাল করেছিলেন। এ ছবির পর প্রোজেক্টটির আর পুনরাবৃত্তি করা হয়নি।
বয়ঃসন্ধিকালের ভালোবাসা-বন্ধুত্বের অম্লমধুর সম্পর্ক আর লাভ ট্রায়াঙ্গল – এসব ছবির বিষয়বস্তু। জাপানি সাহিত্য ও মাঙ্গায় একটি জনপ্রিয় অংশ হলো স্কুলজীবনে ভালোবাসার গল্প। এ ছবিতেও তা-ই ব্যবহৃত হয়েছে।
গল্পের ক্যাটালিস্ট রিকাকো ব্যস্ত মেট্রোপোলিস টোকিও ছেঁড়ে ছোট্ট একটি শহর কোচিতে আসতে বাধ্য হয়েছে। কারণ তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হতে চলেছে৷ রিকাকো এতে তার মা-কেই দোষারোপ করে। শিকোকুর এই ছোট্ট শহরে এসে রিকাকোর খাপ খাওয়াতে প্রথমে বেশ কষ্টই হয়। তাকুর স্কুলেই ট্রান্সফার হয়ে আসে রিকাকো। বড়ো শহর থেকে আসায় তার পোশাক বাকিদের চেয়ে অনেক আধুনিক। তার কথা বলার ধরনও ভিন্ন। তাছাড়া টোকিওর জটিল জীবনাচরণের সাথে কোচির সহজ-সরল মানুষ যায় না।
নস্টালজিয়ায় কাতর তাকু টোকিও যাওয়ার পথে রিকাকোর মতো কাউকে দেখতে পেয়ে এসব ভাবতে থাকে। প্রথমে দূরদূরান্তের অতীতের গল্প বলে মনে হলেও, পরে বুঝা যায় তা আসলে দুয়েক বছর আগের ঘটনা। সীমিত সময়ের ব্যবধানে চরিত্রগুলো অনেক বেশি পরিণত। গল্পটি বলা হয়েছে ফ্ল্যাশব্যাকে। ফ্ল্যাশব্যাক মোটিফটা ছবির শক্তিশালী অংশ।
ছবিতে ছোট ছোট ডিটেইলগুলোর উপর বাড়তি নজর দেওয়া হয়েছে। সুন্দরভাবে নির্মিত ছবিটি মাঝেমধ্যে অতিনাটক বলে মনে হতে পারে। জিবলির বাকি ছবির সাথে একই কাতারে না থাকলে মোটামুটি উপভোগ্যই বলা চলে।

Whisper of the Heart (1995)
ইয়োশিফুমি কন্দোকে হায়াও মিয়াজাকি আর ইসাও তাকাহাতার যোগ্য উত্তরসূরী মনে করা হতো। কিন্তু দুঃখজনক যে এই ফিচারটি তৈরির কয়েক বছর পরই, ১৯৯৮ সালে তিনি মারা যান। তুলনামূলকভাবে কম জনপ্রিয় এই ক্লাসিকটি জাপানিজ মাঙ্গার উপর ভিত্তি করে বানানো। আর সুন্দর এ ফ্যান্টাসির চিত্রনাট্য লিখেছেন স্বয়ং মিয়াজাকি। এমনকি স্টোরিবোর্ডের জোগানও তিনিই দিয়েছিলেন। কিছু দৃশ্যে মিয়াজাকির প্রভাব স্পষ্ট।
১৪ বছর বয়সী শিজুকু সুকিশিমা পড়তে ভালোবাসে আর লেখালিখিও করতে চায়। তার মা থিসিসে ব্যস্ত আর বাবা লাইব্রেরিতে কাজ করেন। তাই ঘরের দেখভাল শিজুকু আর তার বড়ো বোনকে করতে হচ্ছে। এদিকে সামনে তার পরীক্ষা আর সে ভালো রেজাল্ট দরকার। নইলে ভালো কোনো হাইস্কুলে সে ভর্তি হতে পারবে না। সবকিছু সামাল দেওয়া তার জন্য কঠিনই হচ্ছে। অন্যদিকে গল্পের নায়ক সেইজি আমাসাওয়া, বেহালা তৈরি করাই তার নেশা ও পেশা। সে ইতালি গিয়ে বেহালা তৈরি করা ভালোমতো শিখতে চায়।

ছবিটিতে দ্য ব্যারনকে পাওয়া যাবে যে পরে দ্য ক্যাট রিটার্নসে মূল চরিত্র হিসেবে ছিল। বিড়াল এ ছবিতে বিশেষ জায়গা দখল করে রাখে। ছবিতে অনেক রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে। যেমন: কিকির মতো একটি পুতুল, টটরো পুতুল, পর্কো রোসোর ঘড়ি ইত্যাদি।
জন ডেনভারের বিখ্যাত কান্ট্রি রোডস গানটি ছবিতে বারবারই খুব সুন্দরভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। শিজুকু তার চারপাশের নগরায়নকে মাথায় রেখে ‘কংক্রিট রোডস’ গানটি লিখে ফেলে।
নিজেকে চেনার যে যাত্রাটি শিজুকু আর সেইজির মধ্যে দেখা যায়, তা অতটা প্রবলভাবে জিবলির অন্য কোনো ছবিতে দেখা গেছে কি-না সন্দেহ। সম্ভবত মিয়াজাকি বা তাকাহাতার ছবিকে বাদ দিলে, এটি জিবলির সেরা চলচ্চিত্র।
The Cat Returns (2002)
হায়াও মিয়াজাকির ছবি এখনো দেখে না থাকলে, এই ছবিটি আরো বেশি মজার লাগবে। হারু নামের একটি মেয়ে একটি বিড়ালকে মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচায় আর তা থেকেই ঘটনার সূত্রপাত। বিড়ালদের রাজ্যে যাওয়ার সুযোগ পায় হারু।
অ্যানিমেশন স্টাইলটি কিছুটা সরলীকৃত আর অপরিপক্ক মনে হতে পারে, তবে কথা বলা চটপটে বিড়াল ব্যারনকে একেবারে মন্দও লাগবে না। লুইস ক্যারলের এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড আর হারুকি মুরাকামির উপন্যাসের স্বাদও পাবেন এ ছবিতে।
‘Whisper of the Heart’ এর সাবপ্লটের সিকুয়েল হিসেবে কাজ করেছে ছবিটা। সেই ছবির মতো এখানেও মুটা আর ব্যারনকে পাওয়া যাবে। হিরোইয়ুকি মোরিতার মাত্র ৭৫ মিনিটের এ ছবিতে অবশ্য মিয়াজাকি ম্যাজিকটি নেই, তবে উপভোগ্যই বটে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, জিবলির সেরা চলচ্চিত্রের মধ্যে এটি নেই।

Howl’s Moving Castle (2004)
ডায়ানা জোনসের লেখা উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে বানানো ছবিটিতে পাবেন জাদুর প্রাসাদ৷ হাউল এক রমণীমোহন জাদুকর। সবখানে সে ঘরে বেড়ায়। দেখে মনে হবে কতটা স্বাধীন। আসলেই কি সে এত স্বাধীন? পেনড্রাগন, জেনকিন্সের মতো বিভিন্ন নাম তার। ছবিটি নির্মাণের কথা ছিল ‘দ্য গার্ল হু লেপ্ট থ্রু টাইম‘ খ্যাত মামোরু হোসদার। কিন্তু তিনি সরে গিয়ে জায়গা করে দেন মিয়াজাকিকে। মিয়াজাকি নিজের কল্পনার মতো করে আঁকেন সেই সচল প্রাসাদকে। এতে সিজিআইয়ের ব্যবহারও হয়েছে। এরপর থেকে মিয়াজাকি আবার ঐতিহ্যবাহী হাতে আঁকা অ্যানিমেশনে ফিরে গিয়েছেন।
ছবির আরো থিমের মধ্যে রয়েছে আত্মপরিচয় ও মানবিকতার মতো বিষয়গুলো। ছবির নারী চরিত্র সোফি, চিহিরোর মতো আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্বে ভোগে; কিন্তু তারটা চিহিরোর মতো আধ্যাত্মিক না, বরং শারীরিক সৌন্দর্যের জন্য। এক ডাইনি জাদুকরের অভিশাপে সে বুড়ো হয়ে যায়। তবে তার হারানোর ভয় না থাকায়, সে আরো সাহসী আর আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে। ঘুমের মধ্যে সোফি তার আগের রূপে বারবার ফিরে যায়।
ছবিতে যে যুদ্ধ দেখানো হয়েছে তা রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত। ‘নিউজউইক’ ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মিয়াজাকি অকপটেই বলেছেন তাঁর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের কথা। ২০০৪ এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাককে দখলে নেয় এবং যুদ্ধ ঘোষণা করে। তা দ্বারা প্রভাবিত ছিল ছবির যুদ্ধটি। ছবির ইংলিশ ডাবিংয়ে ক্রিশ্চিয়ান বেল আর লরেন বেকলের মতো তারকারা কণ্ঠ দিয়েছেন।

The Secret World of Arrietty (2010)
ম্যারি নরটনের লেখা উপন্যাস ‘The Borrowers’ এর উপর নির্মিত কোনো ছবি তাকাহাতা আর মিয়াজাকি দু’জনের কাছেই ছিল স্বপ্নের মতো। কিন্তু ছবিটির মাধ্যমে হিরোমাসা ইয়োনেবায়াশির পরিচালক হিসেবে আগমন ঘটে।
জাপানে ‘The Borrower Arrietty’ নামে পরিচিত এই ছোট্ট মানুষদের গল্প প্রতি কালচারেই বিদ্যমান। আরিয়েত্তিরা সাধারণ মানুষের পাশেই থাকে, তাদের থেকে বিভিন্ন জিনিস ‘ধার’ নেয় কিন্তু কখনো ‘ধরা’ দিতে চায় না। তার সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে শো নামক টিনেজারের যে তার অসুখ সারাতে নানীর বাড়িতে আসে।
গুরুগম্ভীর কোনো গল্প নয়, জটিলতা নেই তবে মন গলানো। স্কেচে জিবলির ট্রেডমার্ক থাকলেও জিবলি গুরুদের জাদুটা যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। ক্লাসিক ফেইরি টেলের মতো গল্পটির ব্রিটিশ ডাবে রয়েছেন সার্শা রোনান, টম হল্যান্ড প্রমুখ।

From Up on Poppy Hill (2011)
হায়াও মিয়াজাকির ছেলে গোরো মিয়াজাকির তৈরি ছবি এটি। ছবির জন্য গল্পটা তার বাবারই লেখা।
ষাটের দশকের প্রাক্কালে (১৯৬৩ সালে) জাপান ২য় বিশ্বযুদ্ধের গ্লানি, জরা আর ভীতিকর স্মৃতি ভুলে সামনে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তারই ঝলক পাবেন এতে। এর পরের বছরই টোকিও অলিম্পিক যা জাপানের জন্য ছিল একটি টার্নিং পয়েন্ট। বোর্ডিং স্কুলের দুই স্টুডেন্ট উমি আর শান ইয়োকোহামার একটি ক্লাবহাউজকে রক্ষার জন্য লড়তে থাকে।
১৯৮০ সালের জনপ্রিয় মাঙ্গার উপর ভিত্তি করে তৈরি ছবিটি জিবলির বাকি ছবি থেকে আরো সোজাসাপ্টাভাবে গল্প বলে যায়৷ ভালোবাসার মিষ্টি গল্পটি স্মৃতিকাতরতায় পরিপূর্ণ। ছবিটির টার্গেট অডিয়েন্স ছিল টিনেজাররা। তা সহজেই বোঝা যায়।
চোখে স্বস্তি দেবে এমন স্কেচে পরিপূর্ণ টিন ড্রামাটি। যেমন পাহাড়ের দৃশ্যটিই। আবার বাতাসে উড়তে থাকা পতাকা দিয়ে দূরদূরান্তের নাবিকদের সাথে যোগাযোগ করার দৃশ্যটি মনে কিছুটা ভয়ও জাগাবে। কিছু মজার টুইস্ট আছে। দেখতে ভালোই লাগবে। তবে গোরো এখনও তার বাবার মতো দক্ষ হয়ে উঠেননি।

The Wind Rises (2013)
যারা মিয়াজাকির বাকি ছবি এখনো দেখেননি, তারা এটি সবশেষে দেখলেই ভালো। মিয়াজাকির অন্য সব ছবি থেকে এটা অনেক বেশি ব্যতিক্রমধর্মী।
এতে জাদুর দুনিয়া কিংবা কথা বলতে পারা বিড়াল পাবেন না। তবে এটা ফিকশনের আশ্রয় করে গড়ে ওঠা এয়ারক্রাফট ডিজাইনার জিরো হরিকোশির বায়োপিক। মিয়াজাকি হরিকোশির কাজের নিখুঁত আর মেলানকোলিক ছবি এঁকেছেন। দেখলে মনে হবে মাইস্ত্রো মিয়াজাকি তাঁর সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারকে পেছনে ফিরে দেখছেন। গল্পটিকে খুব ফ্যান্টাস্টিকাল একইসাথে বড়ো বেশি বাস্তব মনে হবে।
২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান জিরোর নকশা করা যুদ্ধবিমান মিতসুবিশি A6M ব্যবহার করেছিল৷ জিরো ছিলেন তাঁর কাজে একদম নিখুঁত। অসম্ভবকে হাতের মুঠোয় আনতে চেয়েছিলেন। জিরো হরিকোশিকে দেখলে মনে হবে স্বপ্নচারীকে যেন বাধ্য করা হচ্ছে বাস্তববাদী হতে। অবশ্য মিয়াজাকির ক্ষেত্রেও তো তা-ই।
এখন পর্যন্ত মিয়াজাকির শেষ পরিচালিত ছবি এটিই। এরপরই তিনি অবসরে চলে যান। এখন শোনা যাচ্ছে, উনি ‘How Do You Live?’ ছবির কাজে হাত দিয়েছেন।

When Marnie Was There (2014)
এখন পর্যন্ত জিবলির সর্বশেষ চলচ্চিত্র এটি৷ আরিয়েত্তির পর আবারও ব্রিটিশ গল্পের দ্বারস্থ হয়েছেন হিরোমাসা ইয়োনেবায়াশি। ঔপন্যাসিক জোয়ান জি. রবিনসনের ১৯৬৭ সালে লেখা গল্পের উপর ভিত্তি করে ছবিটি নির্মাণ করেছেন তিনি।
ছবিটি যেন স্টুডিও জিবলির শোকস্তবের মতো। ৩৫ বছরব্যাপী জিবলি ছবিতে যেসব বিষয়বস্তুকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ছবিটিতে।
১২ বছরের আনা কারো সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না, তার পালক মা’য়ের সাথেও না। আনা খুবই বিষণ্ণ এবং হতাশ থাকে৷ সে নিজেকেও অপছন্দ করে। তার বিষণ্নতা আর দশজন টিনেজারের মতো নয়। সে সুইসাইডালও বটে। ইয়াং অ্যাডাল্ট ফিকশনে সচরাচর এটা দেখা যায় না।
আনার অ্যাজমার সমস্যার জন্য তাকে হাওয়াবদলের আশায় গ্রামীণ এলাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেই পটবদল হতে শুরু করে। মার্নি নামের এক রহস্যময়ী কিশোরীর সাথে তার বন্ধুত্ব হয়। মার্নি থাকে নির্জন প্রাসাদোপম একটি বাড়িতে। বাড়িটিকে আশেপাশের লোকজন ভৌতিক বলে দাবি করে। আসলেই কি তা-ই? মার্নি কি তবে ভূত?

মাঝেমধ্যে একে অতিনাটক (melodrama) মনে হতে পারে, তবে ছবিটি তার সুন্দর গল্পকথন দিয়ে আপনার অনুভূতিকে নাড়া দেবে। সাথে জিবলির নজরকাড়া শৈল্পিকতা তো আছেই। ছবির মূল কথা হলো, অতীতের স্মৃতি যত দুঃসহই হোক না কেন, তা মেনে নিয়েই আপনাকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। একাকিত্ব এবং বন্ধুত্বের এ গল্পটি বেশ ধীরলয়ের। তবু এখন পর্যন্ত জিবলির সর্বশেষ ছবি হিসেবে এতটুকু কষ্ট করাই যায়।
Feature Image Courtesy: pinterest.com