সত্তরের দশকের শেষভাগটায় ভারতের জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের বাক স্বাধীনতা যখন ইন্দিরা গান্ধীর ‘ইমার্জেন্সি’ আইনের চাপে হাঁসফাঁস করছে, তখনই মুক্তি পেলো সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা ‘হীরক রাজার দেশে’। হীরক রাজা সবসময়ই স্তুতি শুনতে চায়। কিন্তু দেশের মানুষ খারাপ আছে – এটি বললেই শাস্তি। তাই সব নাগরিককে মগজধোলাই করে দেওয়া হয়। তো সিনেমা মুক্তির পর সবাই ফিসফিস করে বলা শুরু করলো, আরে এতো ইন্দিরা গাঁধীর সমালোচনা করে দিলো। কিন্তু সত্যজিৎ একদম স্পিকটি নট। তিনি বললেন, ‘কই, এ-তো এক রূপকথার গল্প! ফ্যান্টাসি!’
হ্যাঁ, যুগে যুগে ফ্যান্টাসি হয়ে উঠেছে মানুষের প্রতিবাদের ভাষা। সমাজ, রাষ্ট্র যখন মুখ খুলতে দেয় না, তখন কল্পনার গল্প রচনা করে মানুষ কথা বলার চেষ্টা করে। আলমগীর কবিরের চলচ্চিত্র ‘সূর্যকন্যা’-তেও এই কল্পনাশ্রয়ী ব্যাপারটিই মূল চরিত্র হয়ে ফিরে ফিরে আসে। ছোট ছোট সংলাপের মধ্য দিয়ে আমাদের অনেককিছু বলে দিয়ে যায়।

গল্পে আমরা দেখতে পাই নায়ক লেনিন এক মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ছেলে। তার বাবা অর্থোপার্জনকারী পেশা হিসেবে তাকে ডাক্তার বানাতে চাইলেও সে হয়ে উঠেছে শিল্পী। কিন্তু তার আরেকটি স্বভাব কল্পনায় ভাসা। কল্পনা করতে আমরা সবাই ভালোবাসি। কিন্তু চলচ্চিত্রে এমন প্রয়োগ এর আগে বাসু চট্টোপাধ্যায়ের ‘ছোটি সি বাত’ সিনেমায় দেখেছিলাম। এটা না হয়ে ওটা হলে কেমন হতো- এরকম ভাবনাতেই তার দিন কাটে। তার এই কল্পনায় ভর করে এক ছিনতাইয়ের সিকোয়েন্সে আমরা দেখতে পাই এদেশের নাগরিকদের অনিরাপত্তা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। রেসকোর্স মাঠের এক কল্পিত রাজনৈতিক বক্তৃতায় আমরা সেসকল কথা শুনতে পাই যা আসলেই রাজনীতিবিদদের বলা উচিত।

তেমনই কল্পনাকে অবলম্বন করে ‘সূর্যকন্য’ চলচ্চিত্রে পরিচালক দৃষ্টি দেন আমাদের নারীসমাজের দিকে। কল্পনা যে এখানে কতোবড় একটি উপকরণ তা এই ঘটনার সূত্রপাতে বোঝা যায়। বাবার খিটিমিটিতে বিরক্ত হয়ে লেনিন রাজপথে নেমে আসে চাকরির খোঁজে৷ আর নেমে কিছুদূর যেতেই দেখা এককালের বড়লোক বন্ধু রাসেলের সাথে। সেও তার শেরাটন হোটেলের নারী প্রসাধনের দোকানে ইনডোর ডিজাইনের অদ্ভুত কাজ দেয় লেনিনকে, মাসে ৫০০ টাকা বেতনে। সেই অনুযায়ী দোকানের জন্য নারী পুতুল বা ম্যানিকুইন তৈরি করে লেনিন। আর তাতে ক্রমে ক্রমে ফুটে উঠে বিশ্বজুড়ে সুকীর্তিত নারীদের রূপ: শেষের কবিতা উপন্যাসের লাবণ্য, গ্রীক মিথলজির ইউরিডিস বা রোমান পুরাণের ভেনাস। কিন্তু রাত হলেই এই মূর্তি থেকে এক নারী কেবল আবির্ভূত হয় লেনিনের কাছে; আবার ভোর চারটায় মূর্তিতে পুনঃরূপান্তরিত হয়ে যায়।
লক্ষ করার মত একটা ব্যাপার যে, গ্রামবাংলায় একটা বাজে ছড়া প্রচলিত ছিল তুমুল রক্ষণশীলতা প্রকাশের সময়- নারীর সাথে দেখা হবে রুটি বেলার কাঠে, কাপড় কাঁচার ঘাটে আর রাতের বেলা খাটে। ম্যানিকুইনের আবির্ভাব সময়টাও তাই রাত, যে পুরুষ তাকে গড়েছে, তার কাছেই কেবল সে আবির্ভূত হচ্ছে, আর ঐ যে সকাল চারটায় তার প্রস্থান, এ যেন ‘অসূর্যস্পস্যা’ শব্দেরই জোর প্রতিধ্বনি। এখান থেকে সে কি মানবী হয়ে উঠতে পারবে – এ নিয়েই কাহিনী এগোয়। সাথে থাকে সমাজবিজ্ঞানের আলোকে নারীর স্বাধীন থেকে পরাধীন হওয়ার ইতিহাস, তা থেকে মুক্তি পাওয়ার আকুলতার অনুভব জাগানোর প্রয়াস আর রাসেল ও দোকান কর্মচারী মনিকার প্রণয়জনিত সাবপ্লট।

যাহোক, অনেকের কাছে সিনেমাটির গল্প খুব ভালো লাগে। যদিও পুরো সিনেমা জুড়ে অদ্ভুত অনুপযোগী আবহ সঙ্গীত মাথা ধরিয়ে দেয় অনেকের। সম্পাদনা ১৯৭৫ সালের নিরিখেও মনপূত না। এই সিনেমা নিয়ে অনেক ভালো ভালো কথা, সমালোচনা বিভিন্ন ব্লগে আছে। সেসব বড় বড় স্বীকৃত নামের পাশে বক্তব্য পুনরুক্তি তো হবেই, সমুদ্রপাশে গোষ্পদবারি তকমাও জুটতে পারে। তাই দর্শকের মনে যা কিছু দ্বিধা উদিত হতে পারে সিনেমাটি দেখাপরবর্তী সময়ে তা নিয়ে একটু আলাপ করি:
সূর্যকন্যা চলচ্চিত্রটির সময়ব্যপ্তি ১ ঘন্টা ৪৯ মিনিট। এর মধ্যে প্রথম ৪০ মিনিট আমরা নায়ক লেনিন চরিত্রকেই কিন্তু দেখি। লেনিনের সাধ, স্বপ্ন, অপ্রাপ্তি, অতৃপ্তি, কামনা এসবই বারবার ফুটে উঠেছে যেন। তার ঐ কৈশোরের হিপনোটিজমের সিকোয়েন্স তো অনেকটা ইন্দ্রিয়রোচক আদিরস সাহিত্যের মতই। আমরা দেখতে পাই যে কিশোরী (নারী) তার দেহ দানে সহজেই ইচ্ছুক – যেমনটা পুরুষ কল্পনা করতে ভালবাসে। এরও আগে আমরা লেনিন ও রাসেলের নিজস্ব আলাপে কলেজের বান্ধবীর মুটিয়ে যাওয়া নিয়ে আলাপ দেখতে পাই। যার কোন পাল্টা কাউন্টার লেনিনের বোধের উত্তরণ হবার পরও আমরা পাইনি।

রাসেলের নারী প্রসাধনীর দোকানে যে কাপল জিনিস কিনতে আসে সেখানেও ভারতীয় বা বাঙালি নারীর শপিংপ্রীতি নিয়ে যে মিথ প্রচলিত, সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠে। নারী দামি বাহারি জিনিস পছন্দ করে, তাই গুণগত ভালো না হলেও কোনো জিনিসের দাম বাড়িয়ে বললে সে তাই কিনতে উঠেপড়ে লাগে (তার নিজস্ব বিচারবোধ নেই)। আর পুরুষ তার সাধ মেটাতে যথাসাধ্য চেষ্টা চালায়- ঐ সিকোয়েন্স এর বাড়তি কিছু ভাবাতে সাহায্য করেনি।
দোকান সহকারী মনিকা বিশ্বাস চরিত্রটি নিঃসন্দেহে সাহসী। সেটি তার পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়ায় একা জীবন যাপনের সিদ্ধান্তে স্পষ্ট। কিন্তু তার এই স্বাধীনচেতা আকাঙ্খাকে তার একান্ত নিজস্বী আমরা বলতে পারি না। কারণ রাসেলের সাথে ক্রমাগত শারীরিক সম্পর্কের পর বিয়ের স্বীকৃতি না পেয়েই তার হঠাৎ বিদ্রোহের সাধ জেগেছে৷ অথচ সে দক্ষ ইংরেজি বলতে পারা শিক্ষিতা নারী – সিনেমার বড় সময় তার কেটেছে ঠোঁটে লিপস্টিক আর মোহময়ী ইশারা করে। আর এই যে সমাজের চোখে অবৈধ দৈহিক সম্পর্ককে সাহসিকতা হিসেবে উপস্থাপন- এটা অনেকটা পুরুষতান্ত্রিকই লাগে৷ কারণ ব্যাপারটা নরমালাইজ না করে বিদ্যমান রাখা তো পুরুষের জন্যই লাভজনক। তার অলরেডি ব্রোথেল আছে, সেখানে নারী সাহসিকতার নামে এধরনের আচরণের প্রচার স্রেফ একটি বাড়তি সংযোজনমাত্র।

অসূর্য্যস্পর্শা লাবণ্য আবার সূর্যকন্যা হতে চায়, মুক্তি পেতে চায় লেনিনের সাহায্যে। লেনিনের ভালবাসাই পারে তাকে মুক্তি দিতে। হ্যাঁ, নারীবাদ মানে পুরুষ বিরোধিতা না তা আমরা জানি। কিন্তু নারী তো তার নিজস্ব শক্তি দিয়েও মুক্তি পেতে পারে। তার সঙ্গী, সহানুভূতি লাগবেই কেন? আর তার বিনির্মাণে পৃথিবীখ্যাত রূপবতীদের রূপ একটি বড় উপাদান। রূপবতী না হলে কি মন উঠবে না?
আবার লেনিনের পরিবারে তার বাবা স্রেফ আয় করেন। কিন্তু ঘরের অন্যান্য কাজ লেনিনের মাকে করতে দেখি। যখন তিনি কাজ করছেন তখন লেনিনের বাবাকে দেখি আরামকেদারায় শুয়ে পত্রিকা পড়তে। কিন্তু তারপরও আমরা দেখি সংলাপে, দৃশ্যায়নে পরিচালকের বাবার প্রতি আমাদের সহানুভূতিশীল করে তোলার একটা চেষ্টা।

একই বিষয় লেনিনের বোনকে নিয়েও। যেখানে লেনিনের ছোট ভাই রাফ এন্ড টাফ, সেখানে বোন তার প্রেমিক ‘কবি’ বা চাকরির বাজারে অনুপযোগী হবার পরও ফুলকুমারী ধরনেই চলনবলন। মানে ভবিষ্যতের চিন্তা সে তো পুরুষই করবে, এমন।
এসব ছোট ছোট ব্যাপার চোখে লাগে। যা থেকে মনে হয় যে চলচ্চিত্রে নারী মুক্তির বিষয়টা আসলেও এর মাঝে পুরুষতান্ত্রিক উপাদানও আছে। তাহলে এর আড়ালে কি পুরুষতন্ত্রেরই উদ্দেশ্য সাধিত হয়? আপনারা কি ভাবছেন?
Feature Image Courtesy: Youtube.com