‘’A man can be destroyed, but not defeated‘’- Ernest Hemingway
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সেই ‘ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও অপরাজিত’ এমন একজন মানুষ রয়েছেন বাঙালির ইতিহাসে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সার্বক্ষণিক ছায়ার মতো ছিলেন যে মানুষটি, যার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল অসাধারণ এবং যার নেতৃত্ব ব্যতিত আমরা এ স্বাধীনতার পথে হাঁটতে গেলে হোঁচট খেতাম বারবার, তিনি আর কেউ নন, তিনি তাজউদ্দীন আহমদ। ইতিহাসে এমন অনেক সেনাপতি থাকেন যাদের নাম সোনালি অক্ষরে লিখার বদলে তলানিতে ফেলে রাখার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা নীরবে-নিভৃতে দেশকে ভালোবেসে কাজ করে যান অবিরাম, তাজউদ্দীন আহমদ তাদের-ই একজন। স্বাধীনতার দীর্ঘ নয় মাসের পথে একজন তাজউদ্দীন আহমদ কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন আর আওয়ামী লীগের ইতিহাসেই বা তার অবদান কতখানি ছিল তা অনেকেরই অজানা। চলুন ইতিহাসের পাতা উল্টে জেনে নেয়া যাক এই অজানা তাজউদ্দীন আহমেদ সম্পর্কে। জেনে নেয়া যাক একজন সত্যিকারের হিরোকে যার নামে হেনরি কিসিঞ্জারের মত নেতাও ঘোল খেয়ে গিয়েছিলেন, যার প্রখর বুদ্ধিমত্তা অবাক করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা রাজনীতিবিদদের, যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ, বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ!
জন্ম ও ব্যক্তিগত জীবন
তাজউদ্দীন আহমদ ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই গাজীপুর জেলার অন্তর্গত কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মৌলভী মোঃ ইয়াসিন খান এবং মাতা মেহেরুননেসা খান। শীতলক্ষ্যার পারের এক ছোট্ট গ্রামে জন্ম নেয়া তাজউদ্দীন ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অসম্ভব ট্যালেন্টেড একজন ছাত্র। বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত মক্তবে ও দাদার কাছে আরবি শিক্ষার পাট চুকানোর পর ভুলেশ্বরী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। এরপর দাদির অনুপ্রেরণায় তাজউদ্দীন কে জন্মস্থান দরদরিয়া থেকে ৫ মাইল দূরের কাপাসিয়া মাইনর স্কুলে পড়তে দেয়া হয়। এসময় তিনি ব্রিটিশ সরকারবিরোধী ৩ বিপ্লবী নেতার সান্নিধ্যে আসেন। তারা হলেন বীরেশ্বর ব্যানার্জি, মনীন্দ্র শ্রীমানী ও রাজেন্দ্র নারায়ণ চ্যাটার্জি। তাদের সুপারিশক্রমে তাকে কালীগঞ্জের সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউশনে ভর্তি করা হয়। তারপর তিনি ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল থেকে ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ১২তম স্থান অর্জন করেন। ম্যাট্রিকে এত ভালো রেজাল্ট থাকা সত্ত্বেও তাজউদ্দীন আহমদ কিশোর বয়স থেকেই নানা রাজনৈতিক ও সমাজসেবামূলক কাজে জড়িয়ে পড়ায় উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সময়মত দিতে পারেননি।
পরে তিনি ১৯৪৮ সালে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা বোর্ডে ১ম শ্রেণীতে ৪র্থ স্থান অর্জন করেন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বিএ ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে কারাগারে থাকা অবস্থায় এল.এল.বি পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন। তুখোড় মেধাবী এই তরুণ সহজেই পেতে পারতেন যেকোনো সরকারি চাকরি কিংবা উচ্চ পদ। কিন্তু তা না করে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন বাংলাদেশ আর বাংলার জনগণের কাজে।
তার স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ছিলেন বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। তাদের ৪ সন্তান। বাবার মতো সন্তানেরাও দুজনে রাজনৈতিক অঙ্গন বেছে নিয়েছিলেন।
বড় মেয়ে শারমিন আহমদ রিপি; মেজো মেয়ে বিশিষ্ট লেখিকা ও কলামিস্ট এবং গাজীপুর-৪ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি এবং কনিষ্ঠা মেয়ে মাহজাবিন আহমদ মিমি। পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ গাজীপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে আসীন অবস্থায় পদত্যাগ করেন ও ৭ জুলাই, ২০১২ইং তারিখে তার আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়।
রাজনৈতিক জীবনের সূচনা
তাজউদ্দীন আহমদ প্রথম রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন স্কুলে থাকতেই, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের তিন বিপ্লবী নেতার সাথে তখন তার প্রথম পরিচয় হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে হল রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন মোটামুটিভাবে এবং হল ছাত্র সংসদ নির্বাচনে মতামত তুলে ধরেছেন, ভূমিকা রেখেছেন ছাত্র মনোনয়নে। ১৯৪৩ সালে তাজউদ্দীন আহমদ প্রথম মুসলিম লীগের রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত হন। ১৯৪৪ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন।
যুক্তফ্রন্ট ও রাজনীতিতে তাজউদ্দীনের উত্থান
পাকিস্তান আমল থেকেই তাজউদ্দীন আহমদ রাজনৈতিক নানা জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ (বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। ১৯৪৮-এর ১১ এবং ১৩ মার্চ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে ধর্মঘট-কর্মসূচী ও বৈঠক করেন৷ ২৪ মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সাথে বৈঠক করেন তিনি৷ ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম উদ্যোক্তাও ছিলেন। ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত ঢাকা জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের (১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় আওয়ামী লীগ) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
মুসলীম লীগবিরোধী যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয় ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট গঠন নিয়ে মতবিরোধ ছিল। কারণ আওয়ামী লীগের বাইরে তখন তেমন কোনো বিরোধী দলই ছিল না। শেরে বাংলার দল ছিল তড়িঘড়ি করে বানানো কৃষক শ্রমিক পার্টি, কমিউনিস্টরাও যুক্তফ্রন্ট চাইতো, আবার আওয়ামী লীগের ভেতর যারা ক্ষমতার লোভ করত তারাও চাইতো যুক্তফ্রন্ট। তাদের লক্ষ্য ছিল যেকোনো মূল্যে মুসলিম লীগের নিপীড়ন বন্ধ করা। যাহোক, সেই ১৯৫৪’র নির্বাচনে জনবিরোধী মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। তাজউদ্দীন এমএলএ হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে প্রার্থী ছিলেন প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক, সাবেক মন্ত্রী, অ্যাডভোকেট ফকির আব্দুল মান্নান। তিনি ছিলেন প্রভাবশালী ব্যক্তি, নানা দিকের লোকজন তার অনুগত। অন্যদিকে তাজউদ্দীন এর বয়স তখন ত্রিশ ও হয়নি, অর্থবল ও ছিল সীমিত। কিন্তু তাজউদ্দীন এই নির্বাচনে ভোট পেয়েছিলেন ১৯,৩৩৯ আর ফকির আব্দুল মান্নান পেয়েছিলেন ৫,৯৭২। অর্থাৎ তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়নি। অন্যদিকে নির্বাচন উপলক্ষ্যে একটা জাগরণ উঠেছিল গ্রাম বাংলায়। তাজউদ্দীন বহু মানুষের সমর্থন পেয়েছিলেন। যে মানুষটি ছিলেন নিভৃতচারী, নির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছিল তিনি কতটা সামাজিক হতে পারেন। গ্রামে এই বাড়ি ওই বাড়িতে থেকেছেন, খেয়েছেন, হট্টগোলের মধ্যে জনসংযোগ করেছেন।
কিন্ত নির্বাচন এ বিজয় পাবার পর প্রগতিশীলদের নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছিল, তাজউদ্দীন ও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি তার লেখা ১৯৫৪ সালের ডায়েরিতে কিছু অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেছেন। যেমন, তার নির্বাচনী এলাকায় মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হয়েও নেজামে ইসলাম পার্টির শহীদ মোক্তার দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন প্রার্থী হিসেবে এবং তাজউদ্দীন কে যথেষ্ট বিরক্তও করেছেন। নির্বাচনের পরে ৯২-ক ধারার সময়ে এই নেজামে ইসলাম সংখ্যালঘুদের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ধারণা করা অসংগত নয় যে এই নেজামে ইসলামই পরবর্তীতে জামায়াতে ইসলামী ও রাজাকার আলবদর হিসেবে উত্থান হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ ও নেতা তাজউদ্দীন
বঙ্গবন্ধুর মতো তাজউদ্দীন আহমদেরও জীবনের অনেকটা সময় কেটেছিল কারাগারে বন্দী থেকে। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবি যাকে বলা হয় বাঙালির স্বাধিকারের এক দলিল, সেই সময় থেকেই তাজউদ্দীন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহচর। ১৯৬৬ সালের ৮ ই মে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন সহ আরো অনেক নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৯ সালে প্রচন্ড গণ আন্দোলন এর পর বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৬৯ এর ১২ই ফেব্রুয়ারী ঘরে ফিরে আসেন তাজউদ্দীন আহমদ। মুক্তি পাওয়ার ছয় দিন পরেই তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে এক গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে চলে যান। জানা যায়, বঙ্গবন্ধুই বলেছিলেন যে দলের মধ্যে কেউ যদি সুযোগ্য প্রতিনিধিত্ব করতে পারে সে হলো তাজউদ্দীন। আগরতলা মামলা থেকে মুক্ত হয়ে আসার পরেই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাজউদ্দীন হন তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। তাজউদ্দিনের সাথে আলাপ-পরামর্শ করেই বঙ্গবন্ধু নানা দলীয় কর্মসূচি দিতেন। তাজউদ্দীনের বাড়িতে ছিল বঙ্গবন্ধুর অবাধ আসা-যাওয়া। তাজউদ্দীন কন্যা শারমিন আহমদের লেখা বইয়ে তিনি লিখেন যে বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীনের স্ত্রীকে বলতেন ”ওর দিকে খেয়াল রেখো লিলি, ওকে ছাড়া সব অচল”।
নির্বাচনে বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করার পরেও ইয়াহিয়া খান যখন ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তালবাহানা শুরু করলেন এবং ৩রা মার্চ পূর্বনির্ধারিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলেন, তখন দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এরপর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু সেই ঐতিহাসিক ভাষণ রাখেন রেসকোর্স ময়দানে। ২৩ শে মার্চ, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়ির সামনে ছাত্ররা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। এদিকে ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেন গোপনে, অর্থাৎ তাদের ২৫ শে মার্চ ঢাকা আক্রমণ এর পরিকল্পনা করা শেষ। তাজউদ্দিন আহমদ এসময় বঙ্গবন্ধুর সাথে আগে থেকে প্ল্যান করেছিলেন যে তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবেন এবং সেখান থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন। ২৫শে মার্চ কালরাতে তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুকে নিতে গেলেন। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে বঙ্গবন্ধু বেঁকে বসেন এবং কোনোমতেই পালিয়ে যেতে রাজি হলেন না। তিনি তাজউদ্দিন কে দেখে বলেন ”বাড়ি গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকো, ২৭ মার্চ হরতাল ডেকেছি।”
বঙ্গবন্ধুর এই কথায় তাজউদ্দীন ভীষণ মর্মাহত হন। বঙ্গবন্ধু ধরা পড়ে গেলে যে দেশ নেতৃত্বহারা হয়ে যাবে তা নিয়ে তাজউদ্দীন খুব শঙ্কিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ধারণা ছিল এখন পালিয়ে গেলে পাকিস্তানিরা তাকে দেশদ্রোহী হিসেবে আখ্যা দিয়ে দিতে পারে। অন্যদিকে আটক অবস্থায় হয়ত নেগোসিয়েশন করা যাবে। তাজউদ্দীন আহমদ প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে বিশ্বের নানা রাজনৈতিক নেতার উদাহরণ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বুঝানোর চেষ্টা করেন যে আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে অনেক নেতাই যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। কিন্তু তাতে লাভ হলো না।
তাজউদ্দীন তখন বঙ্গবন্ধু কে বলেন ‘আপনার অবর্তমানে কে নেতৃত্ব দিবে এমন ঘোষণা তো আপনি দিয়ে যাননি। ফলে দ্বিতীয় কারো নেতৃত্ব দেয়া দুরূহ হবে এবং মুক্তিযুদ্ধ কে একটি জটিল ও অনিশ্চিত পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়া হবে।”
তাজউদ্দীন আহমদ আগে থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে রেখেছিলেন কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা পাঠ করতে রাজি হলেন না। পরবর্তীতে ২৬ মার্চ সেটিই আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচারিত হয়। ধারণা করা হয় যে, তাজউদ্দীন হয়ত কোনো ছাত্রকে আগে ঘোষণাটি দেখিয়েছিলেন, এরপর সেই ছাত্র স্বপ্রণোদিত হয়ে সেটি বহির্বিশ্বের মিডিয়ার কাছে পৌঁছে দেন। ২৭ মার্চে, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর চোখ এড়িয়ে, দুর্গম যাত্রার সঙ্গী ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের সঙ্গে ঢাকা ত্যাগ করার সময় রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া এক কাগজে তিনি তার স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন লিলিকে লিখেছিলেন–
“লিলি, আমি চলে গেলাম। যাবার সময় কিছুই বলে আসতে পারিনি। মাফ করে দিও। আবার কবে দেখা হবে জানি না…… মুক্তির পর। তুমি ছেলেমেয়ে নিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে মিশে যেও।
— দোলনচাঁপা।(তাজউদ্দীনের ছদ্মনাম)”
কতখানি নিবেদিতপ্রাণ নেতা ছিলেন তাজউদ্দীন তা তার এই ছোট্ট একটা চিরকুট থেকে বুঝতে পারা যায়।
প্রথমে আত্মরক্ষা তারপর প্রস্তুতি এবং সর্বশেষে পাল্টা আক্রমণ এই নীতিকে সাংগঠনিক পথে পরিচালনার জন্য তিনি সরকার গঠনের চিন্তা করতে থাকেন। তাই তাজউদ্দীন আহমদ আত্মগোপন করেন এবং যুদ্ধকে সংগঠিত করার জন্য সীমান্তের দিকে যাত্রা করেন। এরই মধ্যে ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি ফরিদপুর কুষ্টিয়া পথে পশ্চিম বাংলার সীমান্তে পৌঁছান। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ৩১ মার্চ মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পদার্পণ করেন। আমীর-উল ইসলামকে যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাজউদ্দিন আহমদ বৈঠকে বসেন। তাজউদ্দীন আহমদ এসময় বিএসএফ এর কাছে মুক্তিফৌজ গঠনে সহায়তা চাইলে তারা বলে যে, বিদ্রোহী সেনাদের অবস্থান নিয়ে ভারত সরকারের সমর্থন না পাওয়া পর্যন্ত তারা কোনো সাহায্য করতে পারবে না। তখন তাজউদ্দীন বুঝতে পারেন যে তাকে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করতে হবে দিল্লী গিয়ে। দিল্লিতে যাবার পর ভারত সরকার বিভিন্ন সূত্র থেকে নিশ্চিত হন যে, তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠতম সহকর্মী। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের আগে ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদের কয়েক দফা বৈঠক হয় এবং তিনি তাদের বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার জন্য যেসব সাহায্য ও সহযোগিতার প্রয়োজন তা বুঝিয়ে বলেন। এসময় তিনি উপলব্ধি করেন যে আওয়ামী লীগের একজন নেতা হিসেবে তিনি যদি সাক্ষাৎ করেন তবে সামান্য সহানুভূতি ও সমবেদনা ছাড়া তেমন কিছু আশা করা যায় না। সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐ সরকারের দৃঢ় সমর্থন ছাড়া বিশ্বের কোন দেশই বাংলাদেশের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে না। এছাড়া ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের আগের দিন এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাজউদ্দীনের কাছে জানতে চান যে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে কোন সরকার গঠিত হয়েছে কিনা। তাজউদ্দীন আহমদ দৃঢ়তা ও নিষ্ঠার সাথে সিদ্ধান্ত নেন যে বৈঠকে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরূপে নিজেকে তুলে ধরবেন। ঐ বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীর কাছে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য অনুরোধ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, উপযুক্ত সময়ে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হবে। এভাবেই অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ধারণার সূচনা।
মুজিবনগর সরকার ও তাজউদ্দীনের ভূমিকা
৪ঠা এপ্রিল দিল্লীতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীনের আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়। ১০ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা করা হয়। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ দিবসে ভাষণে তাজউদ্দীন দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলেন, “পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন রাষ্ট্রকে লালিতপালিত করছেন। দুনিয়ার কোনো জাতি এই নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হোক কাল হোক দুনিয়ার ছোটবড় প্রতিটি রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে এ নতুন জাতিকে। স্থান দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে।“
এদিনই স্বাধীন বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন তাজউদ্দীন আহমদ। শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
স্বাধীন বাংলাদেশ
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তাজউদ্দীন আহমদ প্রিয় নেতাকে ফিরে পেয়ে খুশিতে বিহ্বল ছিলেন। এরপর ১২ জানুয়ারি নতুন মন্ত্রিসভা হয় এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর পদ বঙ্গবন্ধু কে ছেড়ে দেন। তিনি নিজে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি ঢাকা-২০ আসন (বর্তমানে গাজীপুর -৪ আসন) থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম বাজেট পেশ করেন এবং পাঁচশালা পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন।
অদূরদর্শী, সাদাসিধে জীবন ও সদা উন্নত শির
তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এমন একজন ব্যক্তিত্ব যাকে দেশ বিদেশের অনেক ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা ভয় পেতেন এবং সমীহ করতেন। ১৯৬৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী ভুট্টো দলবল নিয়ে এক বৈঠকে ঢাকায় আসেন, তাজউদ্দীন সেইখানে ছয় দফার যৌক্তিকতা প্রমাণ করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। সেদিন তাজউদ্দীনের সাথে কথা বলে ভুট্টো বুঝতে পারেন যে তাকে তর্কে হারানো কঠিন। আলোচনা শেষে ভুট্টো মুসলিম লীগের নেতাদের কাছে মন্তব্য করেন ”হি ইজ ভেরি থরো। শেখের যোগ্য লেফটেন্যান্ট আছে দেখছি!”
১৯৭১ সালের নভেম্বরের দিকে মার্কিন সিনেটর কেনেডি ও ব্রিটিশ এমপি ডগলাসম্যান সহ কিছু বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সাথে তাজউদ্দীনের সাক্ষাৎ হয়। তার সাথে আলোচনার পর ডগলাসম্যান যুক্তরাজ্যের হাউস অফ কমন্স এ যে আলোচনা তুলে ধরেন গিয়ে, তাতে তাজউদ্দীনের যুক্তিগুলোরই প্রতিফলন ছিল। কেনেডির সাথে সাক্ষাৎকার এর আগেরদিন তাজউদ্দীন নিজের একটিমাত্র শার্ট নিজে ধুয়ে দিচ্ছিলেন, কারণ তার আর শার্ট নেই বলে। এ থেকে বুঝা যায় তিনি কতটা সাধারণ থাকতে পছন্দ করতেন।
কেনেডি জাতীয় প্রেস ক্লাবে দেয়া এক বক্তব্যে বলেছিলেন যে, যখন তিনি পূর্ববাংলার নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলেন তখন একজন আওয়ামী নেতা পরিহাস করে বলেছেন তাকে যে ”বহু রাষ্ট্র এবং বহু মানুষ আমেরিকায় আসে বিলিয়ন ডলার সাহায্য চাওয়ার জন্যে, যা দিয়ে আরো অস্ত্র কেনা যায়, আরো রসদ সংগ্রহ করা যায়। আমরা বাঙালিরা শুধু এটুকুই চাই যে তোমরা কোনো কিছুই যোগান দিয়ো না। তোমরা শুধু নিরপেক্ষতা অবলম্বন করো।“ পরে জানা যায় যে তাজউদ্দীনের হয়ে আমীর উল ইসলামই এই উক্তি করেছিলেন।
১৯৭২ সালে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে তাজউদ্দীন আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেখানে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো হয়, ইন্দিরা গান্ধী ইচ্ছা করেই প্রাক্তন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট ম্যাকনামারার সাথে তাজউদ্দীন কে বসানোর ব্যবস্থা করেন যাতে তারা কথাবার্তা বলতে পারেন। পুরো অনুষ্ঠানের সময়টা ম্যাকনামারা কথা বলার চেষ্টা করলেও তাজউদ্দীন ফিরেও তাকান নি। কারণ মার্কিন সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে বলে তাজউদ্দীন প্রচন্ড ক্ষুব্ধ ছিলেন। তার এই এড়িয়ে যাওয়া অনেকেরই চোখে পড়ে। অনুষ্ঠান শেষে তার সচিব আবু সাঈদ চৌধুরী তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন “মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা কি তা কি আপনি জানেন?” সাঈদ তখন বলেন যে ম্যাকনামারা তখন ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে ছিলেন, তিনি তো আমেরিকার গভর্নমেন্ট না। তাজউদ্দীন তাকে উত্তর দেন “হি ইজ সুপার গভর্নমেন্ট! এদের রোল ছিল আমাদের মেরে ফেলার। তার সঙ্গে আমি কি করে কথা বলি!”
তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন এমন একজন মানুষ যাকে বাংলাদেশের জন্য নানা জায়গায় হাত পাততে হয়েছে দেশের কল্যাণ আনতে, কিন্তু তিনি তার সম্মান বিসর্জন দিয়ে হাত পাতেননি। সত্য বলায় তিনি ছিলেন সর্বদা সচেষ্ট।
যেভাবে দূরত্ব সৃষ্টি হলো
তাজউদ্দীন আহমদই স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্রের নানা অসংগতি তুলে ধরতে থাকেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন আহমদের লেখা বই থেকে জানা যায় যে বঙ্গবন্ধু কখনো যুদ্ধের নয় মাসের গল্প জানতে চাননি। তাজউদ্দীন বলতে চাইলেও বঙ্গবন্ধুর উদাসীনতা দেখে তিনি বলতে পারেননি। সে কারণে কারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি আর কারা বিপক্ষের তা কখনোই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেননি। তিনি উল্টো তার ৩০ বছরের রাজনৈতিক সঙ্গী তাজউদ্দিন কে অবিশ্বাস করতে শুরু করেন। এমনও জানা যায় যে বঙ্গবন্ধু এক পর্যায়ে তাজউদ্দীনের কার্যক্রম এর ওপর নজরদারি শুরু করেন। তাজউদ্দীন আহমদ চেয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধী সবাইকে বাংলাদেশে ফেরার সুযোগ দেয়া হোক যাতে পরে তাদের বিচারের আওতায় আনা যায়, এতেও বঙ্গবন্ধু সায় দেননি। যদি দিতেন তাহলে হয়তো স্বাধীনতার পর এতগুলো বছর আমাদের লাগতো না যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে। তাজউদ্দীন আহমদ এসময় খন্দকার মোশতাকের ষড়যন্ত্র ও ধরে ফেলেন এবং তাকে কড়া নজরে রাখেন। যার প্রতিশোধ পরে বেশ নির্মমভাবেই নিয়েছিলেন মোশতাক। তিনি তার তোষামোদি দিয়ে ক্রমশ বঙ্গবন্ধুর থেকে তাজউদ্দীনকে আলাদা করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন যে তাজউদ্দীন ও বঙ্গবন্ধুর বন্ধুত্ব নষ্ট না হলে তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবেনা।
তাজউদ্দীন ক্রমেই বুঝতে পারছিলেন যে মন্ত্রীসভায় তার আর থাকা হবে না, কারণ অনেক বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে অমত তৈরি হচ্ছিল। শেষ যে বিষয়ে তাজউদ্দীন বিরোধিতা করেন তা হলো বঙ্গবন্ধুর বাকশাল বা একদলীয় সরকার গঠন কে। যেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য বাংলাদেশ সংগ্রাম করেছে সেখানে কোনো বিরোধী দল থাকবে না, সমালোচনার সুযোগ থাকবে না, তাজউদ্দীন কোনোভাবেই মানতে পারেননি বিষয়টা। এর প্রেক্ষাপটে তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭৪ সালের ২৬ শে অক্টোবর মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। দেশবাসী অবাক হয়ে যায়, খবরে শিরোনাম হয় কিন্তু কেউই বুঝতে পারলো না যে এই পদত্যাগে আসলে তাকে বাধ্য করা হয়েছে। এতোকিছু সত্ত্বেও তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে একটি বাক্য কোথাও উচ্চারণ করেননি।
নক্ষত্রের পতন!
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধু তার ধানমণ্ডির বাড়িতে সপরিবারে খুন হন। রেডিওতে ভেসে আসে মেজর ডালিমের উত্তেজিত কন্ঠ, “খুনী মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে!” তাজউদ্দীন বেদনায় বিমূঢ় হয়ে পড়েন। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন “আমি মন্ত্রীসভায় থাকলে কারো সাহস ছিল না মুজিব ভাইয়ের শরীরে সামান্য আঁচড় কাটার।“ কিন্তু তাজউদ্দীন কি তখন জানিতেন যে নরপিশাচরা তাকেও বাঁচিয়ে রাখবে না? তাজউদ্দীন এর এক সতীর্থ তাকে পরামর্শ দেন ভারতে আশ্রয় নেয়ার। কিন্তু তাজউদ্দীন বলেন যে পথে একবার গিয়েছেন সে পথে আর ফিরে যাবেন না। এখন পালিয়ে গেলে মানুষের ধারণা হবে তিনিই বঙ্গবন্ধু কে খুন করে পালিয়েছেন।
২২ শে আগস্ট শুক্রবার তাজউদ্দীন এর বাড়ির সামনে দুটি জীপ এসে থামলো। একজন পুলিশ অফিসার এসে বললো “স্যার, আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।” তাজউদ্দীন সঙ্গে নিলেন কিছু জামাকাপড়, কোরান শরীফ আর একটা ডায়েরী। ছেলেমেয়ে সবার মাথায় হাত বুলালেন যাওয়ার সময়। বেগম জোহরা তাজউদ্দীন জিজ্ঞেস করলেন “কি মনে হয়? কবে ছাড়বে তোমাকে?” সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে তাজউদ্দীন বললেন “Take it forever! ধরে নাও চিরদিনের জন্যই যাচ্ছি!” সত্যিই এই ছিল তার শেষ যাওয়া, পরিবারের সাথে শেষ দেখা।
১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর খন্দকার মোশতাক ও মেজর আব্দুল রশীদের নির্দেশে জেলে তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও এইচ এম কামরুজ্জামান কে হত্যা করা হয়। তাজউদ্দীনের শরীরে তিন জায়গায় বুলেটের দাগ দেখতে পাওয়া যায়। সেই সাথে নিভে যায় বাংলার আকাশ থেকে একটি নক্ষত্র, নেতৃত্ব শূন্য হয়ে যায় বাংলাদেশ আর বিশ্ব দেখতে পায় নিজ জাতির সাথে প্রতারণার ও বিশ্বাসঘাতকতার একটি বড় উদাহরণ!
তাজউদ্দীনের ডায়েরি ও অন্যান্য
তাজউদ্দীন আহমদ পুরো ১৯৫৪ সাল জুড়ে একটি ডায়েরি লিখেন যা পরবর্তীতে তার মেয়ে শারমিন আহমদ উদ্ধার করেন। পুরো ডায়েরিই তিনি ইংরেজিতে লিখেছিলেন যা পরে বেলাল আহমেদ ও সিমিন হোসেন রিমি অনুবাদ করেন। তৎকালীন রাজনৈতিক ইতিহাস জানার জন্যে এটি এক অতি মূল্যবান দলিল। তাজউদ্দীন আহমদ সেনাদের হাতে আটকের সময় শেষ যে ডায়েরিটি সাথে নিয়েছিলেন তাতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের নানা কার্যক্রম লিপিবদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এই ডায়েরিটি জেলে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি তার মৃত্যুর পর।
এছাড়া তাজউদ্দীন কন্যা শারমিন আহমদ তার বাবার সম্পর্কে স্মৃতি ও পুরো রাজনৈতিক জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছেন তার লেখা ‘তাজউদ্দিন আহমদ, নেতা ও পিতা’ বইটিতে। তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে তানভীর মোকাম্মেলের পরিচালনায় ‘Tajuddin Ahmad: An Unsung Hero’ নামে একটি ডকুমেন্টারি করা হয়েছে। ‘Glory and Despair: The Politics of Tajuddin Ahmad’ নামে সৈয়দ বদরুল ওমরের একটি বই রয়েছে। কাপাসিয়ায় তাজউদ্দীন-ময়েজউদ্দীন স্মৃতি সংসদ রয়েছে, যেখান থেকে নানা অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় প্রতিবছরই। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে নানা বিখ্যাত মানুষ তাজউদ্দীন আহমদের কাজ নিয়ে কথা বলেছেন ও লিখেছেন।
যে মানুষটি বাংলাদেশ কে ভালোবেসেছিলেন, হয়েছিলেন বঙ্গতাজ, সেই মানুষটিকে হয়তো আমরা তার প্রাপ্য দিতে পারিনি। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ বেঁচে থাকবেন সংগ্রামে। তাজউদ্দীন আহমদ বেঁচে থাকবেন তার কথায় ও কাজে, যেভাবে তিনি বলেছিলেন দীপ্ত কন্ঠে “মুছে যাক আমার নাম, তবুও থাকুক বাংলাদেশ!” কিন্তু বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে তাজউদ্দীন কখনো মুছে যাবেন না, বরং তরুণ প্রজন্মের আদর্শের প্রতীক হয়ে থাকবেন একজন তাজউদ্দীন আহমদ।
Feature Image Courtesy: ourislam24.com