২০১৮ সালে অস্কার পেয়ে সারা বিশ্বের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ‘রোমা’। কিন্তু কেন?- কারণ রোমা ঠিক সিনেমা হলেও বড় পর্দায় ওভাবে মুক্তি পায়নি। হলিউডের বড় কোন গোষ্ঠী এর প্রযোজকও না। নেটফ্লিক্স নামে এক অনলাইন প্রদর্শন মাধ্যম এর প্রযোজক। পিসি, ল্যাপটপ বা মোবাইল এসব ছোট পর্দার জন্য যারা কাজ করে, তাদেরই এমন বড় প্রাপ্তিতে সবাই বেশ নড়েচড়ে বসলো। আর নেটফ্লিক্স প্রবেশ করলো বিনোদনের সবচেয়ে বড় বাজার ভারতে। দিবাকর বন্দোপাধ্যায়, অনুরাগ কাশ্যপের মত লোকদের দিয়ে বানাতে লাগলো একের পর এক কাজ। বাকিরাও বসে থাকবে কেন। এমাজন, সনি এরাও মাঠে নামলো। আর বাংলা অঞ্চলে চলচ্চিত্রের মাফিয়া যারা, সেই ভেঙ্কটেশ গ্রুপের লোকজনও লঞ্চ করলো ‘হৈচৈ’কে।

এদিকে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অনেক এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশ অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। দর্শক গ্রহণ করবে কি-না, মানুষ টাকা খরচ করে দেখবে কি-না, পাইরেসি কপির জন্য লস হবে কি-না, এসব ভেবে বাংলাদেশী মিডিয়া জগতের সবাই-ই ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ব্যাপারে অনেকটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন। তার ওপর মোবাইল কোম্পানি ভিত্তিক প্লাটফর্ম হওয়ায়- যেমন গ্রামীণফোনের বায়োস্কোপ, রবির আইফ্লিক্স ইত্যাদি হওয়াতে ব্যবসা, কন্টেট কিছুই ঠিকমত হচ্ছিল না। কিন্তু এই ফাঁকা মাঠে দুই বাংলার বাংলাভাষী চলচ্চিত্রপ্রেমীদের জন্য হৈচৈ তাদের প্ল্যাটফর্মে একের পর এক দুর্দান্ত সিরিজ রিলিজ দিয়েই যাচ্ছিল। কখনো তাতে শরীরী ব্যাপারের আধিক্য রুচিশীল দর্শকের ভ্রু কুঁচকালেও কিছু কিছু সিরিজ ভালোই প্রশংসা পায়।

আর এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের একটি আদ্যোপান্ত মৌলিক কাজ হিসেবে হৈচৈ-এ মুক্তি পেলো সৈয়দ আহমেদ শাওকী পরিচালিত এবং চঞ্চল চৌধুরী অভিনীত ‘তাকদীর’। যা ইতোমধ্যেই বেশ প্রশংসায় ভাসছে নানাবিধ দিক থেকে। এই প্রসঙ্গে মজার ছলে বলাই যায় যে চঞ্চল চৌধুরীর কপাল বেশ সুপ্রসন্ন। তার অভিনীত ‘আয়নাবাজি’ আর ‘মনপুরা’ এখনো দেশীয় সিনেমার সাফল্য বিচারের মাপকাঠি। নতুন কোন চলচ্চিত্র মুক্তি পেলেই দর্শক এগুলোর সাথে তুলনা দেয়। তেমনি এই ওয়েব সিরিজটিও যাত্রা করছে তেমন সম্মান অর্জনের পথে।
চলচ্চিত্রের নিয়মিত দর্শকরা প্রচুর সিনেমা দেখে। কিন্তু যতই ভিনদেশের নয়নজুড়ানো কাজ দেখি, কিংবা ‘মাটির প্রজার দেশে’ অথবা ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ এর মত বিদেশী কলাকুশলীদের সহযোগিতায় করা দেশী কাজ – আমাদের মন থেকে একটি ভাল কাজের জন্য যে আফসোস, তা আর যায় না। ‘তাকদীর’ এই দিক দিয়ে হৈচৈ প্রোডাকশনের প্রযোজনা থাকা সত্ত্বেও শতকরা ১০০ ভাগ খাঁটি দেশী কাজ।

‘তাকদীর’ মূলত প্রতিদিনের জীবনভিত্তিক দর্শনে আর্থ-সামাজিক প্রতিক্রিয়ার একটি থ্রিলার গল্প। নয় এপিসোডের এই ওয়েবসিরিজে লাশবাহী এম্বুলেন্স চালক তাকদীরের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী। তার গাড়ির ফ্রিজারে এক প্রখ্যাত সাংবাদিকের লাশ পাওয়ার পর থেকে দুর্দান্ত থ্রিলের সাথে গল্প সামনে এগিয়ে যায়। এই লাশ নিয়ে গল্পের প্রতিটি চরিত্রই দুর্ভোগ পোহাতে থাকে। কেউ লাশটিকে পেতে চায়, আর কেউ চায় এই লাশের হাত থেকে নিষ্কৃতি। পুরো গল্পের অধিকাংশই লাশবাহী এম্বুলেন্সকে ঘিরে এগিয়ে গেলেও প্রথম তিন এপিসোড ‘রসাতল,’ ‘রদবদল’ এবং ‘রণক্ষেত্রে’ দুর্দান্তভাবে সৈয়দ শাওকী ব্যবহার করেছেন চরিত্রগুলোর বিনির্মাণে। দর্শক যাতে চরিত্রগুলোর সাথে মানসিকভাবে সংযুক্ত হতে পারে, সেজন্য ধীরে ধীরে নন লিনিয়ার ধরনে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় প্রত্যেকটি চরিত্রকে। পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার স্ক্রিনে উপস্থাপন ও ব্লকিংয়ে যথেষ্ট সময় দিয়েছেন এবং দক্ষতার সাথেই চরিত্রগুলোর শেষ দেখিয়েছেন।

তবে গল্পের সবচেয়ে প্রশংসার বিষয় হওয়া উচিত এই যে, দেশের কোন নির্মাতা প্রথমবারের মত সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং ধর্ষণের মত সিরিয়াস ইস্যুতে যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা ও যৌক্তিকতার সাথে কাজ করে দেখিয়েছেন। দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন যে আসলে বিদ্যমান, ধর্ষণের মত ঘৃণ্য অপরাধ করেও অপরাধী যে প্রশাসনের উদাসীনতায় পার পেয়ে যায়, পরিচালক তা আমাদেরকে বোঝাতে চেয়েছেন। ‘ঠাকুরপাড়া’ অঞ্চলের নাম একবার মাত্র উচ্চারণ করে পরিচালক কাদেরকে উচ্ছেদ ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয় বুঝিয়েছেন, মনোযোগী দর্শক না হলে তা বোঝা যদিও দুষ্কর। তবুও মুক্তিযুদ্ধের পলায়নপর নির্যাতিত গোষ্ঠী বা ইন্টারফেইথ প্রেম কাহিনীর গল্পে নারী চরিত্রের বাইরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে তুলে আনার জন্য পরিচালক সৈয়দ শাওকী কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা পাবার যোগ্য।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে যে চঞ্চল চৌধুরী কোনো চলচ্চিত্রে আছেন, আর সেখানে অন্যরা তার সাথে টেক্কা দিয়ে বা হয়তো তাকে ছাপিয়ে অভিনয় করবে, এটা একসময় ভাবাও যেতো না। তাকদীরের নাম চরিত্র চঞ্চল চৌধুরী হলেও মন্টু চরিত্রে সোহেল মণ্ডল, সাংবাদিক আফসানার চরিত্রে সানজিদা প্রীতি, মইনুল রানার চরিত্রে মনোজ প্রামাণিক, চেয়ারম্যান সায়মন চৌধুরীর চরিত্রে ইন্তেখাব দিনার, ডোমের চরিত্রে নাসির উদ্দীন খান এবং হিটম্যানের চরিত্রে পার্থ বড়ুয়া চঞ্চল চৌধুরীর সাথে একরকম পাল্লা দিয়ে অভিনয় করে গেছেন। বিশেষ করে সোহেল মণ্ডল আর নাসির উদ্দীন খানের নাম আলাদাভাবে নিতেই হয়। তাকদীরের পুরো কাস্টের মধ্যে সোহেল মন্ডলই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আলোচিত তার হৃদয়গ্রাহী পারফরম্যান্সের জন্য। কিন্তু খাস চাটগাঁইয়া নাসির সাহেব যেভাবে বিহারী উচ্চারণে ডোমের টোন অবতারণা করেছেন, তা হ্যাটস অফ!

তাকদীরের সিনেমাটোগ্রাফার বরকত হোসেন পলাশ যথেষ্ট দক্ষতার সাথে নিজের কাজে শতভাগ দিয়েছেন। এছাড়া সাউন্ডে রাজেশ সাহা ও মিক্সিংয়ে রিপন নাথও যথেষ্ট মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। তবে তাকদীরের ডায়লগ যিনি লিখেছেন, নিয়ামত উল্লাহ মাসুম এবং যিনি পোশাক পরিকল্পনা করেছেন, গুপী বাঘা প্রোডাকশনের ইদিলা ফরিদ তুরিন, এই দুজন আলাদা করে স্থান পাবেন। বিভিন্ন সময়ে চঞ্চল চৌধুরীকে দিয়ে যে দার্শনিক কথাবার্তা বলানো হয়েছে বা পার্থ বড়ুয়াকে দিয়ে সাহিত্যের ভাবে যে সেন্স অফ হিউমারযুক্ত কথা বলানো হয়েছে, তা বাংলাদেশের যেকোনো চলচ্চিত্রের ডায়লগ থেকে অনেক ওপরে। তেমনি একদম বাস্তবানুগ কস্টিউম ডিজাইনিংও অনেক প্রশংসার যোগ্য।

এই সিজনের যে মিসিং পার্টগুলো রয়ে গেছে, তা নিয়ে আশা করি খুব দ্রুতই তাকদীরের সেকেন্ড সিজন আসবে। যারা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে ভালোবাসে, তাদের তাকদীরের মত কাজগুলোর সম্মানার্থে পাইরেসি করে না দেখে হৈচৈ সাবস্ক্রাইব করে তাকদীর দেখা। আমাদের সকলের সহযোগিতাতেই তো আমরা এগিয়ে যেতে পারব।
Feature Image Courtesy: CinemaRare