তারেক মাসুদ। চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক ও চিত্র নাট্যকার। আধুনিক বাংলা চলচ্চিত্রের ত্রাণকর্তা হিসেবে যার আগমন ঘটেছিল। ক্ষণস্থায়ী জীবনে যিনি তার সৃষ্টিকর্ম দিয়ে বিস্ময় তৈরী করে গেছেন। এক কথায় বলতে গেলে, সাধারণত্বের মাঝের সৌন্দর্যকে যিনি ‘লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন’ এই শব্দত্রয়ের মাঝে নান্দনিকভাবে প্রস্ফুটিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন; তিনিই তারেক মাসুদ।
ফরিদপুরের ভাঙ্গার নূরপুর গ্রামে ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর তারেক মাসুদ জন্মগ্রহণ করেন। মা নুরুন নাহার মাসুদ ও বাবা মশিউর রহমান মাসুদ। ভাঙ্গা ঈদগা মাদ্রাসা থেকে তারেক মাসুদের শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়। ঢাকার লালবাগের একটি মাদ্রাসা থেকে তিনি মৌলানা পাস করেন। যুদ্ধের পর সাধারণ শিক্ষার জগতে তার অনুপ্রবেশ ঘটে। ফরিদপুরের ভাঙা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। তারেক মাসুদ জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ক্যাথরিন মাসুদকে। সিনেমা নিয়ে কাজের সূত্রেই পরিচয় হয় তাদের। পরবর্তী জীবনে একসঙ্গে অনেক কাজও করেছেন তারা। তাদের একমাত্র সন্তান নিষাদ বিংহাম পুত্রা মাসুদ।

১৯৮২সাল। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থেকে সবেমাত্র ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স শেষ করেছেন তারেক মাসুদ। এ সময় শিল্পী এস এম সুলতানকে নিয়ে আহমদ ছফা রচিত একটি লেখা তারেক মাসুদের মনকে নাড়া দেয়। শুরু করে দেন তার প্রথম প্রমাণ্যচিত্র ‘আদম সুরত’। ১৯৮২-১৯৮৯ সাল। ১৬ মিলিমিটার ক্যামেরায় ধারণকৃত ৫৪ মিনিটের এ প্রমাণ্যচিত্র নির্মাণ করতে দীর্ঘ সাত বছর লেগেছিল তারেক মাসুদের। এস এম সুলতানের জীবন নিয়ে নির্মিত এ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণকালীন লোকে হাসাহাসিও কম করেনি তাকে নিয়ে। অনেকেই জিজ্ঞেস করত, “শেষ করতে পারবা না আর ছবিটা? নাকি সুলতানের মরণের জন্য ওয়েট করছো?” কিন্তু এসব কটূক্তিতে ব্যক্তি তারেক মাসুদ কিংবা তার কাজ কোনোটাই প্রভাবিত হয়নি। সহাস্য কন্ঠে তিনি বলতেন, “আমি শেষ করতে চাই তবে তা শেষ করার জন্য নয়, কাজটা শেষ হলেই শেষ করবো।”

এ কাজ করতে গিয়ে খুব কাছ থেকে এস এম সুলতানকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল তারেক মাসুদের। সুলতানের জীবন-দর্শন বিশেষত বাঙালি সমাজ, সংস্কৃতি নিয়ে তার ধ্যান-ধারণা গভীরভাবে দাগ কেটেছিল এই তরুণ নির্মাতার মানসপটে। এ প্রসঙ্গে তারেক মাসুদের বক্তব্য ছিল, এ ছবি করতে তার সাত বছর লেগেছে। সাত বছরে মানুষ হয়ত তেরটা ছবি করে। কিন্তু তার জীবনে পরবর্তীতে যত অর্জন সবই এই সাত বছরের জন্য অর্জিত হয়েছে।
ইনিই তারেক মাসুদ। যার কাছে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির চেয়েও মা, মাটি ও মাতৃভূমির জন্য ভালো কিছু করার আকাংখা ছিল প্রবল। অবশ্য আশাহত হতে হয়নি তাকে। ‘আদম সুরত’ মুক্তির পর বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল। এর প্রথম প্রদর্শনী হয় ১৯৮৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং ১৯৯১ সালে ঢাকার গ্যোটে ইনিস্টিউটে প্রামাণ্যচিত্রটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী করা হয়।

তারেক মাসুদ ও তার সহধর্মিণী ক্যাথরিন মাসুদ পরিচালিত আরেকটি কালজয়ী কাজ ১৯৯৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মুক্তির গান’ নামক প্রামাণ্যচিত্র। ১৯৭১ সালে মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা লিয়ার লেভিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর বিশেষত মুক্তিযুদ্ধকালীন গানের দলের ওপর ২০ ঘন্টার ফুটেজ সংগ্রহ করেন। তার ইচ্ছে ছিল একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণের। যদিও পরে আর তা করা হয়নি লেভিনের। ১৯৯০ সালে তারেক মাসুদ সেই ফুটেজ সংগ্রহ করেন এবং কিছুটা পরিমার্জিত করে ‘মুক্তির গান’ নামের একটি চলচ্চিত্রে রুপ দেন। এ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ফিল্ম সাউথ এশিয়া পুরস্কার লাভ করেন। ছবিটির ব্যাপক সফলতা প্রসঙ্গে তারেক মাসুদ বলেন, “মানুষ লাইন ধরে একটা ছবি দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন। এমন দৃশ্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কল্পনাতীত। তবে এমন ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯৫ সালে। আমাদের নির্মিত ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক ছবি ‘মুক্তির গান’ দেখার জন্য।”

যদিও ছবিটি মুক্তির পর পরই সিনেমা হলে দেখানো সম্ভব হয়নি। এ সময় তারেক-ক্যাথরিন দম্পতি গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষকে ছবিটি দেখিয়েছিলেন। ছবিটি নিয়ে মানুষের আবেগ, উচ্ছ্বাস তাদেরকে মুগ্ধ করেছিল। পরবর্তীতে তারা ‘মুক্তির কথা’ নামের আরেকটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এটি ছিল ‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রেরই সিক্যুয়েল। মূলত ‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রটিকে গ্রামীণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে গিয়ে তাদের যে আবেগ অনুভূতির সন্ধান পেয়েছিলেন তারেক মাসুদ তাই ফুটেজ আকারে ক্যামেরায়বন্দী করেছিলেন এবং এরই পরিপ্রক্ষিতে নির্মাণ করেছিলেন ‘মুক্তির কথা’।

প্রশ্ন হতেই পারে, মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক অসংখ্য চলচ্চিত্রের মাঝে কেন তারেক মাসুদের ‘মুক্তির গান’ ও ‘মুক্তির কথা’ চলচ্চিত্র দুটি আপন সৌকর্যমন্ডিত হয়ে আছে? প্রত্যুত্তর হলো, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গৎবাঁধা ও একঘেয়েমি চিরাচরিত গল্পের বাইরে গিয়ে তারেক মাসুদ তার এ দুটি চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নবরুপায়ণ ঘটিয়েছেন যা দর্শকশ্রোতাদের চিন্তাশক্তিকে উদ্বেলিত করেছে এবং দর্শকদের মনে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে।

‘মাটির ময়না’ চলচ্চিত্রটি দিয়ে তারেক মাসুদ নিজের নামের সার্থক স্বাক্ষর রেখে গেছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের পাতায়। ধর্মীয় কুসংস্কারের সাথে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সম্মিলন ঘটিয়ে ২০০২ সালে তিনি চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। বলা হয়ে থাকে, ছোটবেলায় পরিচালকের মাদ্রাসা শিক্ষাজীবনের অভিজ্ঞতার সংস্পর্শ পাওয়া যায় এই ছবিতে। এ ছবি দিয়ে তারেক মাসুদ প্রথামবারের মতো বাংলাদেশি চলচ্চিত্রকে নিয়ে গিয়েছিলেন কান চলচ্চিত্র উৎসবের বিশ্বমঞ্চে। এছাড়াও বাচসাস পুরস্কার, কারা চলচ্চিত্র উৎসব, মারকেচ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ইত্যাদিতে ছবিটি জায়গা করে নিয়েছিল। প্রথম কোন বাংলা সিনেমা হিসেবে বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্রে অস্কারের জন্য প্রথম মনোয়ন পায় ‘মাটির ময়না’। অনেকটা বাংলা চলচ্চিত্রের ফেরিওয়ালা হয়ে তারেক মাসুদ তার ‘মাটির ময়না’ নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর বুকে।
তারেক মাসুদের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাজগুলো হলো- ‘অন্তর্জাল’, ‘ভয়েসেস অফ চিলড্রেন’, ‘নারীর কথা’, ‘আ কাইন্ড অফ চাইল্ডহুড’ ইত্যাদি। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘নরসুন্দর’ নামে এক স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনী চিত্রও তিনি নির্মাণ করেন। ‘চলচ্চিত্রযাত্রা’ নামের একটি বইও লিখেছেন তারেক মাসুদ যেখানে চলচ্চিত্র নিয়ে তার সৃজনশীল ও বস্তুনিষ্ঠ চিন্তাধারার ছাপ পাওয়া যায়।

তারেক মাসুদের সর্বশেষ মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র ‘রানওয়ে’। বিমানবন্দরের রানওয়ের পাশের এলাকায় গড়ে ওঠা এক সাধারণ দরিদ্র পরিবারের ঘটনাই এ সিনেমার উপজীব্য। বস্তাপচা বাণিজ্যিক ছবির ভিড়ে তারেক মাসুদ তার নির্মিত প্রতিটি ছবিতে সাধারণ মানুষের জীবনকে সাবলীলভাবে তুলে ধরেছিলেন। যে কারণেই হয়ত ‘তারেক মাসুদ’ নামটি সিনেমাপ্রেমীদের কাছে এক ভালোবাসার জায়গা হয়ে রয়েছে আজও।

‘কাগজের ফুল’ নামক চলচ্চিত্রের শুটিংস্পট দেখার জন্য ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট তারেক মাসুদ ও তার কয়েকজন সহকর্মী মানিকগঞ্জের সালজানা গ্রামে যান। এরপর আর ঢাকা ফেরা হয়নি তার। ফিরতি পথে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ঘিওর এলাকায় বিপরীত দিক থেকে আসা এক বাসের সাথে তাদের মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। ঘটনাস্থলেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই খ্যাতিমান পরিচালক। দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া সেই মাইক্রোবাসটি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) পাশে স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশের সংস্কৃতিমঞ্চকে শূন্য করে দিয়ে গেছেন তারেক মাসুদ। বেঁচে থাকলে এতদিনে হয়ত তার চলচ্চিত্র বাংলার প্রতীকী হয়ে দাপিয়ে বেড়াত পুরো বিশ্ব। ক্যামেরার চোখ যার কাছে ব্যবসা নয় বরং শিল্পের সমতুল্য ছিল সেই তারেক মাসুদের অভাব কখনো কি পূরণ করা আদৌ সম্ভব হবে?
Feature Image Courtesy: ekushey-tv.com