বিখ্যাত ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক বিখ্যাত কীর্তি ‘সেই সময়’ উপন্যাসটি। উপন্যাসটি সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের বাংলা নিয়ে। তারই এক চরিত্র ছিল চন্দ্রনাথ। ভাগ্যের ফেরে যে একসময় হয়ে ওঠে চাঁদু ডোম। শ্মশানেই তার বসবাস। দলবল নিয়ে মৃতদেহ দাহ করতে সাহায্য করে সে। তেমনই একদিন তারা একটি মৃতদেহ পায়- আলুলায়িত কুন্তলা গৌরবর্ণা যুবতীর। যার শরীরে একটি চাদর ছাড়া আর কোন কাপড় নেই। তারপরই চাঁদুর দলের এক সদস্য সেই মৃতদেহের উপর পাগলের মত ঝাপিয়ে পড়ে। চাঁদু তাকে সরানোর চেষ্টা করতে করতেই আরো দুজন একই কাজ শুরু করে।
হ্যাঁ পাঠক, শুনে গা রি রি করলেও মৃতদেহের প্রতি যৌন আচরণের এই বিকৃত বিশ্রী ব্যাপারটার নাম নেক্রোফিলিয়া এবং তা আরো সুপ্রাচীন। কদিন আগে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে মুন্না ভকত নামে যে ডোম ধরা পড়লো তার কেচ্ছাটিও এই বিকৃত ধারারই এক প্রতিফলন। তো এই বিষয়ের উপর বেশ কিছু সিনেমা বানানো হলেও সাম্প্রতিককালে বহুল চর্চিত ও আলোচিত একটি সিনেমা হলো, ‘দ্যা কর্পস অফ আন্না ফ্রিৎজ’।

হেক্টর হার্নান্দেজ পরিচালিত স্প্যানিশ এই সিনেমায় মুখ্য চরিত্র তিন বন্ধু। হাসপাতালের মর্গে কাজ করা পউ, তার এক মাথাগরম বন্ধু ইভান আর অন্য একজন জাভি। একদিন পাউয়ের হাসপাতালে আসে বিখ্যাত অভিনেত্রী আন্না ফ্রিৎজের মৃতদেহ। পাউ সেটি অতি উৎসাহে তার বন্ধুদের বলে। বন্ধুরাও এই সুযোগে একজন সেলেব্রিটিকে দেখতে চায়। পাউ ইভান আর জাভিকে মৃতদেহের কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু তারপরই ইভান সিদ্ধান্ত নেয় যে সে নায়িকা, হোক মৃতদেহ, তার সাথে যৌন সংসর্গ করবে। জাভি পুরোপুরি বাঁধা দিলেও পাউয়ের সহযোগিতায় বেশি সুবিধা করতে পারে না। ইভান তার বিকৃত বাসনা চরিতার্থ করে। তারপর পাউ একই ব্যাপার করতে গেলে প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে আন্নার শরীরে পুনরায় প্রাণের সঞ্চার হয়। সম্ভবত সে কোমায় চলে গিয়েছিল, ধীরে ধীরে তার দেহে চেতনার সঞ্চার হয়।
এখন সে বেঁচে থাকলে তো পাউয়ের চাকরি যাবেই, ধর্ষণের অভিযোগে ইভানেরও বড় শাস্তি হতে পারে। এই ঝামেলা এড়ানোর জন্য ইভান আন্না ফ্রিৎজকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। যেহেতু পুরো বিশ্ব জানে যে সে মৃত, তাই নতুন করে ঝামেলায় কেউই পড়তে চায় না। জাভি স্বাভাবিকভাবে এর বিরোধিতা করে। এখান থেকেই গল্প শুরু করে অপ্রত্যাশিত সব মোড় নেয়া।

এই জায়গায় আমরা দেখতে পাই ভারতীয় দর্শনের উপস্থিতি। ভারতীয় দর্শনচিন্তা অনুযায়ী প্রকৃতির তিনটি গুণ আমাদের নিয়ন্ত্রণ করেঃ সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ। সত্ত্ব হচ্ছে ধীরস্থির, মঙ্গলময়। আর তমঃ একদম অধঃপতিত, নিম্নস্তরী ভাবনা চিন্তা। রজো এই দু’টোর মাঝখানে। তিন বন্ধু যেন সেই তিনগুণের প্রকাশ। জাভি সত্ত্ব, পাউ রজো, ইভান তমোঃ গুণ প্রধান। এই তিনগুণের লড়াইয়ের উপর জীবাত্মা আন্না ফ্রিৎজের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে৷ কিন্তু স্রেফ এটুকু ইন্টারপ্রিটেশানের জন্যই ভারতীয় দর্শন বলছিনা। কারণ দর্শন এও বলে যে এই তিনগুণ জীবকে পুরোপুরি সাহায্য করতে পারেনা। মানুষকে নিজেই নিজের মুক্তি অর্জন করতে হয়। এই বক্তব্য সিনেমাতেও এসেছে। কিন্তু পুরোপুরি অসাড় এক শরীর নিয়ে কীভাবে আন্না দুই অসুরের মোকাবেলা করলো, সেজন্য এই সিনেমা আপনার দেখতেই হবে৷
আবার ফিরে আসি মৃতদেহের প্রতি এই বিকৃত যৌন আচরণ নিয়ে। সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া সেই বীভৎস ব্যাপার নিয়ে বিখ্যাত চিত্রগ্রাহক সিরাজুল হোসেন লিখেছিলেন, “পাঁচজন কিশোরী যাদের বয়স যথাক্রমে- ১১, ১৩, ১৪, ১৬ এবং ১৭ বছর। এই অল্প বয়সে তাদের জীবনের যন্ত্রণা এতই তীব্র ছিল যে তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। কিশোর বয়সে জীবনের যন্ত্রণার কারণ সবসময়ই অন্য মানুষ। বিশেষ করে পরিবার বা আপনজনের দুর্ব্যবহার, অবহেলা, নির্যাতন ও এমপ্যাথির অভাব। সেগুলো থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে মরে গিয়েও তাদের শান্তি মেলেনি। মর্গে তাদের লাশ কাটা ছেঁড়া করতে নিলে সেখানেও মৃত অবস্থায় নির্যাতিত হয়েছে তাদের অভিমানী দেহগুলো।”

আগেই বলেছি, মৃতদেহের প্রতি যৌন আগ্রহ একটি মানসিক সমস্যা যার নাম নেক্রোফিলিয়া। নেক্রোফিলিয়া অনেক রকম অস্বাভাবিক যৌনচিন্তা বা যৌন ইচ্ছার অন্তর্গত যাদের একসাথে বলা হয় প্যারাফিলিয়া। ২০০৮ সালে লেখা ‘Forensic and Medico-legal Aspects of Sexual Crimes and Unusual Sexual Practices’ বইতে উল্লিখিত হয়েছে ৫৪৯ রকম প্যারাফিলিয়ার কথা। এর মধ্যে নিম্নোক্ত উদাহরণগুলোর সাথে সম্পৃক্ত খবর মিডিয়ায় আমরা প্রায়ই দেখে থাকি যেমন- পেডোফিলিয়া (শিশুদের প্রতি), বায়াসটোফিলিয়া (রেপ বা রেপ ফ্যান্টাসী), এক্সিবিশনিজম (দেহ বা যৌনাঙ্গ প্রদর্শন), ফ্রটিউরিজম (অপরিচতদের দেহ স্পর্শ, ঘর্ষণ), ইনফ্যান্টোফিলিয়া (কোলের বাচ্চা)।
এই সকল প্যারাফিলিয়া যেমন ব্যক্তির আভ্যন্তরীণ কারণে দেখা দিতে পারে, আবার পরিবেশ পরিস্থিতি ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের আক্রান্ত করতে পারে। শিশু কিশোর বয়সেই যদি এমন চরিত্রগুলোর অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায় তাহলে সময় মত ব্যবস্থা নিলে সেটা অপরাধের পর্যায়ে যায় না বা অপর ব্যক্তি বা সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। নেক্রোফিলিয়া কেন হয় বিজ্ঞানের সঠিক জানা নেই। যেমন এই সিনেমায় একরকম তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা আন্না ফ্রিৎজের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে জাভির মত নৈতিকতার শক্ত ভিত্তি ছাড়া একে প্রতিহত করা কী করে সম্ভব!

সিনেমায় আমরা যদি তিনটি চরিত্রের ব্যাকগ্রাউন্ডও বিচার করি, তাহলে দেখব যে সবচেয়ে আক্রমনাত্মক যে, ইভান, তার পরিবার একধরনের ব্রোকেন ফ্যামিলি। তাকে যখন জাভি নিজের মা বা বোন সম্পর্কে স্মরণ করায় তখন সে তাচ্ছিল্যভরে কটুক্তি দিয়ে জাভির প্রস্তাবনা নাকচ করে দেয়। তেমনি পাউয়ের ক্ষেত্রে বোঝা যায় যে তার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলেও বাবা মার সাথে তার সম্পর্কটা অনেকটা লুকোছাপার। যেজন্য সে অতীতেও এমন কাজ করে কোন দোষী অনুভব করে না৷ আর এসব কাউন্টার দেয়ার ধরন থেকে জাভির একটি তুলনামূলক সুস্থ পরিবেশে বেড়ে ওঠা স্পষ্ট হয়।
তাই আমাদের আসলে আমাদের সমাজের প্রান্তিক দিকগুলোর দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত। কারণ, স্রষ্টা না করুক, আমরা আমাদের মেয়েদের তো জীবিত থাকতেও নিরাপদ রাখতে পারিনা। মৃত্যুর পর নাহয় একটু শান্তি দিই।
Feature Image Courtesy: gruesomemagazine.com