‘খাইছে আমায় খাইছে রে, মদের নেশায় পাইছে রে / সানডে মানডে কোলোজ কইরা দে, ও তোরা সানডে মানডে কোলোজ কইরা দে।‘
১৯৯৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হিট সিনেমা ‘তেজী’ তে দেখা গেলো এক নতুন খলঅভিনেতাকে। কয়েকজন স্বল্প-বসনা ফিল্ম এক্সট্রার সাথে নৃত্যরত তিনি। আর গাইছেন এই গানটি। এই লোকটি নিজেই ছবিটির প্রযোজক। পরিচালনায় ছিলেন কাজী হায়াত। কালোবর্ণের হিংস্রতাপূর্ণ চোখের এই প্রযোজক কাম অভিনেতার আসল নাম মনোয়ার হোসেন ডিপু।
বড় দুই ভাই শাহাদাত হোসেন বাদশা ও আনোয়ার হোসেন আফজাল ছিলেন চলচ্চিত্র ব্যবসার সাথে যুক্ত। ভাই আফজালের নামের সাথে মিলিয়ে তিনি পর্দা নাম হিসেবে নিলেন ডিপজল। তার ঢাকাইয়া ভাষায় দেয়া সংলাপ, হিংস্র চাহনি আর চেহারার প্যাটার্ন তাকে পরিণত করলো সে সময়ের জনপ্রিয় এক খলনায়কে। নায়ক মান্নার সাথে নায়ক-খলনায়ক রিদম তৈরি করলেন তিনি। পরিণত হলেন আলোচিত এক ফিগারে।
তেজী ছবি দিয়ে সাফল্য পেলেও এটাই কিন্তু তার প্রথম ছবি নয়। এর আগে মনতাজুর রহমান আকবরের পরিচালনায় ‘টাকার পাহাড়’ ও ‘হাবিলদার’ নামে দুটি ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন ডিপু। কিন্তু দুটি ছবিই ফ্লপ হয়। এরপর ১৯৯৪ সালে ঢাকায় বিএনপি সমর্থক প্রার্থী হিসেবে ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। সে সময় সাংবাদিক ওয়াহিদ মুরাদ অপরাধবিচিত্রা পত্রিকায় ডিপজলের বিরুদ্ধে একটি ফিচার লেখেন। এরপর কিছুদিন কোলকাতায় অজ্ঞাতবাসে ছিলেন তিনি।
যা হোক, তেজী ছবির সাফল্যের পর ডিপজলের চলচ্চিত্রে সেকেন্ড ইনিংস শুরু হলো খলঅভিনেতা হিসেবে। পরের বছর অর্থাৎ, ১৯৯৯ সালটি ছিল আক্ষরিক অর্থেই তার বছর।
‘বর্ডার থাইকা ইন্ডিয়ান গরু আনার সময় যেমন গরুর হোগায় সিল মাইরা দেওয়া হয়, আমিও তেমনি তোর গায়ে সিল মাইরা দিসি। তুই যেইখানেই যাইবি লোকে তোরে কইবো বিষুর বউ।’ ১৯৯৯ এর ১০ জানুয়ারি মুক্তি পায় সুপারহিট সিনেমা ‘ভয়ংকর বিষু।’ মনতাজুর রহমান আকবর পরিচালিত এ ছবিতে প্রযোজনা ও খলচরিত্রে অভিনয় করেন ডিপজল। ছবির চরিত্র বিষু এতটাই আলোচিত হয় যে, তার পরবর্তী বেশকিছু ছবিতেও তার নাম ছিল বিষু।
‘ভয়ংকর বিষু’ ছবি হিসেবে ছিল সুপারহিট। তবে ছবিটি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যথেষ্ট আলোচনা হয়। ছবিতে দেখানো কলিজা বের করে খাওয়ার দৃশ্যটি বেশ সমালোচিত হয়। ‘তেজী‘ ছবির ‘সানডে মানডে ক্লোজ‘ এর মত এ ছবিতে ডিপজলের ব্যবহৃত জার্গন ছিল ‘ক্যাড়াব্যাড়া’।
‘আগুন পুড়াইয়া মারে, পানিতে ডুবাইয়া মারে, বিষু ক্যাড়াব্যাড়া কইরা মারে।‘ – এই সংলাপটি ছিল খুবই আলোচিত। এ ছবিতে এই জার্গন দিয়ে তার চরিত্রের গান ছিল – ‘জ্বলে আগুন বুকেতে, দে আগুন দে নিভাইয়া দে… লাগা, লাগা ক্যাড়াব্যাড়া।‘
ডিপজল তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় হিটের দেখা পান এ বছরই। তার গল্পে ও প্রযোজনায় নির্মিত কাজী হায়াত পরিচালিত ছবি ‘আম্মাজান’ দিয়ে। এ ছবিতে মান্নার বিপরীতে তার ডায়লগ-পাল্টা ডায়লগ জমে ওঠে। বিশেষত খাটিয়া ধরার দৃশ্য কিংবা শেষদিকে হাসপাতালের দৃশ্যগুলোতে। এছাড়া এই ছবির ‘এই ছেমড়ি তোর কপাল ভালো’ গানটি ছিল খুবই হাস্যকর ও ডার্ক হিউমারাস।
ঐ বছরই তার প্রযোজিত ও কাজী হায়াত পরিচালিত ‘ধর’ (১৯৯৯) ছবিটি মুক্তি পায়। এ ছবিতে বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারীদের জীবন তুলে আনা হয়। এখানেও মান্না-ডিপজল দ্বৈরথ দেখা যায়।
তবে বাংলা ছবিতে সহিংসতা এবং অশ্লীলতার বিষয়টিও বেড়ে উঠতে থাকে ডিপজলের এই অধ্যায়ে। এনায়েত করিমের ‘কদম আলী মাস্তান’ কিংবা মোস্তাফিজুর রহমান বাবুর ‘ভয়াবহ’ ছবিগুলোর ধর্ষণদৃশ্যগুলো ছিল কুরুচিপূর্ণ। এছাড়াও গানগুলোতে এক্সট্রাদের ভঙ্গিমা ছিল অশ্লীল।
২০০০ সালে ডিপজল ব্যাপকভাবে আলোচিত হন মালেক আফসারীর ‘হীরা চুনি পান্না’ ছবির জন্য। এ ছবিটি তার খলনায়ক ক্যারিয়ারে বড় একটি হিট। এখানে এক হিজড়া সেজে প্রতারণা করতে দেখা যায় তাকে। গল্প বা চরিত্র শক্তিশালী হলেও তিনি বরাবরের মতো একই ধাঁচের অভিনয় করে যান। সব ডায়লগেই তার এক্সপ্রেশন ছিল একই রকম। এই ছবিতেই সম্ভবত তার সবচেয়ে বেশি আলোচিত-সমালোচিত ডায়লগগুলো ছিল। যেমন– ‘হিসাব বোঝোনা, দুদু খাও?’ কিংবা ‘হ মাইয়া, তুই ঠিকই ধরছোস, তর বেরেন (ব্রেন) আছে; আয় যাইগা পাটক্ষেতে!’
ডিপজল এ সময়ে কাজী হায়াত কিংবা মনতাজুর রহমান আকবরের সাথে বেশকিছু কাজ করেন। এগুলোতে তার খলঅভিনয় ছিল তুলনামূলক মানসম্মত। যেমন- ‘কষ্ট’ ছবির সেই সন্ন্যাসীর চরিত্রটি। তবে তার অভিনয় এক্ষেত্রে সেই নির্দিষ্ট ধাঁচের বাইরে বেরোতে পারেনি।
ডিপজলের এ সময়ের আলোচিত আরেকটি ব্যবসাসফল ছবি ছিল ‘ক্ষ্যাপা বাসু’ (২০০২)। এ ছবিতে তার ডায়লগ- ‘তর মরণের চুলকানি উঠছে, আমি তরে মলম লাগাই দিমু!‘ ব্যাপক আলোচিত হয়। ঐ বছরই ‘ঢাকাইয়া মাস্তান’ ছবিতে তার বিল্লাল মিশরি চরিত্রটিও যথেষ্ট আলোচিত হয়।
তবে খলঅভিনেতা হিসেবে আলোচিত হলেও তার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার বেশ অভিযোগ ছিল। বিশেষত ছবিতে কুরুচিপূর্ণভাবে চিত্রায়িত নারী ধর্ষণ বা নিপীড়নের দৃশ্য কিংবা নারীদের শরীরের বিশেষ বিশেষ জায়গায় ক্যামেরা ধরার বিষয়টি ছিল দৃষ্টিকটু।
তার গানগুলো তার চরিত্রকে প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হলেও কিছু কিছু গানে কুরুচিপূর্ণ কথা ও এই ক্যামেরা সংক্রান্ত বিষয়টি চোখে পড়ে। যেমন– ‘কলসি ফুটা কইরা দিমু, সাবান দিমু ডইলা’ কিংবা ‘কী বাত্তি লাগাইলি’-র মত গানগুলো।
এবারে আসা যাক তার জনপ্রিয়তার বিষয়ে। খলঅভিনেতা হিসেবে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন ডিপজল। ‘আম্মাজান’ যেমন অলটাইম ব্লকবাস্টার, আবার ‘ভয়ংকর বিষু’, ‘কষ্ট’, ‘হীরা চুনি পান্না’-ও সুপারহিট। এক্ষেত্রে বড় একটা বিষয় ছিল তার গিমিক। তার চোখের এক্সপ্রেশন ছিল দুর্দান্ত। আর ছিল ভয়ংকর দর্শন চেহারা। সাথে তার কমিক ডায়লগ আর কন্ঠস্বর তার চরিত্রগুলোকে ডার্ক হিউমারাস করে তুলেছিল।
চলচ্চিত্রের অশ্লীলতায় ও বি-গ্রেড ধরণের অশ্লীল ছবির ক্ষেত্রে অবশ্যই তার দায় আছে। তবে ২০০৪-০৫ সালের দিকে এফ আই মানিক পরিচালিত ‘কোটি টাকার কাবিন’ ছবিটি প্রযোজনা করে তিনি পজিটিভ রোলে আসেন। প্রযোজনা করেন ‘চাচ্চু’, ‘দাদীমা’-র মত দর্শকপ্রিয় ছবি। এরপর বিভিন্ন ছবিতে নায়কের রোলও করেছেন। তবে সেসবে পাননি খলনায়কের মত জনপ্রিয়তা।
ব্যক্তিজীবনেও বিভিন্ন অভিযোগে একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছেন ডিপজল। ২০০৮ সালে সামরিক শাসনামলে অস্ত্র মামলায় ৪৫ বছরের কারাদন্ড হয় তার। পরে তিনি জামিনে মুক্ত হন। কয়েকবছর আগে পুলিশ পিটিয়েও খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন তিনি।
তার খলঅভিনেতা হিসেবে জনপ্রিয়তায় বাস্তবিক খলসুলভ চেহারা যেমন ভূমিকা রেখেছে, তেমনি তার চরিত্রগুলোর ধরণও রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ডিপজল এর পূর্বের খলনায়কদের কাজ ছিল মূলত জমি-জমা দখল কিংবা প্রেম-ভালোবাসা বা বংশমর্যাদাগত বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব। ডিপজলের আগমনে খলচরিত্রগুলো আরো বিস্তৃত হয়ে উঠলো। যেমন-কোন একজন দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীর ক্যাডার কিংবা অপরাধের সর্দার। কিংবা সন্ত্রাস, খুন বা চোরাচালানের মত কাজ যার কাছে ডালভাত। পাশাপাশি প্রতিটি ছবিতে তার ব্যবহৃত ডায়ালগ বা জার্গনগুলো তার চরিত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে ভালো ভূমিকা রেখেছে।
এককথায়, ডিপজলের ছবিগুলো বা তার খলচরিত্র সেসময়ের রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তায়নের একটা প্রতীক হয়ে থেকেছে। বাস্তবের ড্যাম কেয়ার ডিপজল কিংবা পর্দার ডার্ক হিউমারাস সহিংস বিষু বা কালাম হয়তো একারণেই এতটা জনপ্রিয়তা অর্জন করে নিতে পেরেছিল।
Feature Image Courtesy: banglatribune.com
References:
- ডার্ক হিউমার ডিপজল: মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়
- বাংলাদেশের চলচ্চিত্র: সংকটে জনসংস্কৃতি- গীতি আরা নাসরিন ও ফাহমিদুল হক