ম্যান্ডেলা ইফেক্ট বলতে এমন পরিস্থিতিকে বোঝায় যেখানে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী এমন কোনো ঘটনায় বিশ্বাস করে যা বাস্তবে কখনো ঘটেইনি।
ফিওনা ব্রুম নামক জনৈক নারী মনে করতেন নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যু হয়েছে ১৯৮০’র দশকে কারাগারে বন্দী অবস্থায়। কিন্তু বাস্তবে তা কখনো ঘটেনি কারণ মাদিবা মারা যান ২০১৩ সালে। এদিকে এমন চিন্তা কিন্তু ব্রুম একা করেননি, তার মতো আরও অনেকেই ম্যান্ডেলার মৃত্যুর ঘটনাকে ভুলভাবে ভেবেছিলেন। ব্যাপারটা ব্রুমকে আশ্চর্য করে। ২০০৯ সালে ব্রুম একটি ওয়েবসাইট খুলে এই ঘটনাটিকে ‘ম্যান্ডেলা ইফেক্ট’ নাম দিয়ে জনসমক্ষে আনেন।
ফরেস্ট গাম্প সিনেমার সেই বিখ্যাত লাইনটি তো সবার মুখে মুখে ফেরে। ‘Life is like a box of chocolates…’ অনেকের কাছেই এটি অতি প্রিয় একটি লাইন। কিন্তু আপনি বোধহয় খেয়াল করেননি গাম্প যখন বেঞ্চিতে বসে কথাটি বলছিলেন তখন তিনি মূলত বলেছিলেন ‘Life was like a box of chocolates…’। অর্থাৎ একটি বিশাল সংখ্যক মানুষ ভুল শুনেছেন, ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আপনি যদি সিরিয়াস সিনেমা দর্শক না হন, তাহলে এ ভুলটা করা অসম্ভব কিছু নয়।
কিন্তু তাই বলে এই ভুলটা শুধুশুধুই হয়ে গেল? এখানে অবশ্য একটা কারণ রয়েছে। মূল সিনেমায় ‘was’ থাকলেও সিনেমাটির প্রমোশনের সময় ‘is’ ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু মানুষ যেহেতু ‘Life is like a box of chocolates…’ ভার্সনটির অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত নয় এবং না জেনেই তা ব্যবহার করছে, তাই ব্যাপারটাকে ম্যান্ডেলা ইফেক্টের কাতারে অবশ্যই ফেলা যায়।
ম্যান্ডেলা ইফেক্ট ঘটতে পারে যখন মানুষ ইতিহাসের দিকে ভালোমতো নজর না দিয়েই সিদ্ধান্তে পৌঁছান। যেমনটা ঘটেছে নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুর স্থান, তারিখ নিয়ে। এরকম ইতিহাসভিত্তিক আরেকটি ম্যান্ডেলা ইফেক্টের উদাহরণ হলো জন এফ. কেনেডি’র হত্যার সময় তার লিমুজিন গাড়িটিতে কতজন মানুষ ছিলেন তার সংখ্যা নিয়ে। অনেকে মনে করেন ওই গাড়িতে তখন চারজন মানুষ অবস্থান করছিলেন। দুজন সামনে, আর দুজন পেছনে। কিন্তু আদতে গাড়িটিতে আরোহীর সংখ্যা ছিল ছয়জন। চালক, দুজন সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট, টেক্সাসের গভর্নর ও তার স্ত্রী এবং জন এফ. কেনেডি ও জ্যাকি কেনেডি।
এ ম্যান্ডেলা ইফেক্টের অন্যতম কারণ হচ্ছে গাড়ির দেহাকৃতি ও ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল। আপনি যদি এক পলক ছবিটার দিকে তাকান, তাহলে মনে হবে এটি বুঝি একটি সেডান গাড়ি, সামনে-পেছনে দুটি করে মোট চারটি সিট। তার ওপর লিমুজিন গাড়ির নকশা সম্পর্কে আপনার ধারণা না থাকলে তো কথাই নেই। ঠিক এমনটাই হয়েছে বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে। গাড়িটিতে মোট চারটি সিট কল্পনা করেছেন তারা। গাড়ির উইন্ডশিল্ড ও অন্যান্য ডিজাইনের কারনে সামনের দুজনকে ভালোমতো না তাকালে চোখে না পড়ারই কথা।
প্রেসিডেন্টের গাড়ি থেকে এবার চলে যাওয়া যাক আরেক ‘প্রেসিডেন্টের গাড়ির’ দিকে। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরার্ড ফোর্ড-এর সাথে ফোর্ড গাড়ির কোনো সম্পর্ক নেই, তবে ফোর্ড গাড়ির লোগোর সাথে ম্যান্ডেলা ইফেক্ট ঘটার উদাহরণ রয়েছে। ফোর্ড গাড়ির লোগো’র ‘F’ বর্ণটির নিম্নাংশ একটু টেনে বের করা হয়েছে নকশা হিসেবে। কিন্তু অনেকেই যখন ফোর্ড লোগো’র কথা ভাবেন তখন এই বাড়তি বক্রাক্ষটির কথা মনে করতে পারেন না। তাদের দাবি হচ্ছে এই নকশাটি প্রথম থেকে ছিল না, পরে যোগ করা হয়েছে। কিন্তু সত্যিটা হলো ফোর্ড-এর লোগো’র বঙ্কিম সূচনা বর্ণটি ১৯০০ সালের দিকে যেমন ছিল (একটি ব্যতিক্রম ব্যতীত), এখনও তেমনই আছে।
ম্যান্ডেলা ইফেক্টের দৃষ্টান্ত ইন্টারনেটে অহরহ পাওয়া যায়। অনেকে বিশ্বাস করেন পোকেমন পিকাচু’র লেজের গোড়ায় একটি কালো দাগ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার অস্তিত্ব কখনো ছিল না। মিস্টার রজার্স’ ‘নেইবারহুড’ টিভি সিরিজ অনেকেই দেখেছেন। যদি না দেখে থাকেন তাহলেও টম হ্যাঙ্কস-এর ‘আ বিউটিফুল ডে ইন দ্য নেইবারহুড’ সিনেমাটি দেখে থাকলে মি. রজার্স-কে চেনার কথা। জানতেন কি ফ্রেড রজার্সের এই শো-এর থিম সং ‘It’s a beautiful day in the neighborhood’ নয় বরং ‘It’s a beautiful day in this neighborhood’? হ্যাঙ্কসের সিনেমার কারণে আপনার ভুল ধারণা আরও পাকাপোক্ত হয়েছে, তা-ই না? স্পিলবার্গের সিনেমা ‘ইটি দ্য এক্সট্রা টেরিস্ট্রিয়াল’-এ ইটি কখনো ‘ইটি, ফোন হোম’ বলেনি। বরং সে বলেছিল ‘ইটি, হোম ফোন’। কিন্তু মানুষ প্রথম শব্দবন্ধটিই মনে রেখেছে। ইন্টারনেটে বিভিন্ন জায়গায় এটাকে ম্যান্ডেলা ইফেক্ট বললেও এ লেখক এ ব্যাপারে নিশ্চিত নন। কারণ সিনেমার শেষ পর্যায়ে এসে সংজ্ঞাহীন ইটি সচেতন হওয়ার পর ‘ইটি, ফোন হোম’-ই উচ্চারণ করেছিলেন। পাঠক চাইলে এ ব্যাপারে আরও একটু অনুসন্ধান করে দেখতে পারেন।
আপনি হয়তো জানেন অস্ট্রেলিয়ার কোন পাশে নিউজিল্যান্ডের অবস্থান। হ্যাঁ, মানচিত্রের হিসেবে নিউজিল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। কিন্তু একদল লোক আছেন যারা মনে করেন দেশটি অস্ট্রেলিয়ার উত্তর–পূর্ব দিকে অবস্থিত! বিশ্বাস না হলেও সত্যি যে এরকম ভুল ধারণাও মানুষ নিশ্চিন্তে ও আত্মবিশ্বাসের সাথে করে থাকেন।
ম্যান্ডেলা ইফেক্টের কারণ হিসেবে অলটারনেটিভ রিয়ালিটি, ফলস মেমরি, অনেস্ট লাইয়িং ইত্যাদি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। অলটারনেটিভ রিয়ালিটি তত্ত্ব মোতাবেক আমাদের টাইমলাইনের সাথে আরেকটি বিকল্প টাইমলাইনও সচল থাকে এবং এই দুই টাইমলাইনের সংঘর্ষের কারণেই মানুষের স্মৃতির পরিবর্তন হয়। আবার মানুষ যখন কোনো কিছু মনে করতে চায় তখন তার সেই স্মৃতিধারী নিউরনের সাথে সাথে আরও কিছু সমধর্মী নিউরনও কাজ শুরু করে। ফলে স্মৃতিভাণ্ডার থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিকৃত অবস্থায় মনে ধরা দেয়। অনেস্ট লাইয়িং তত্ত্ব বলে মানুষের স্মৃতিভাণ্ডারে যখন কোনো স্মৃতি কম পড়ে যায় বা হারিয়ে যায় তখন মস্তিষ্ক নিজে থেকেই নতুন মিথ্যা স্মৃতি তৈরি করে। এ ঘটনাকে কনফ্যাবিউলেশন (Confabulation) বলে।
ফরেস্ট গাম্প ছাড়া অন্য রেফারেন্সগুলোর সাথে আপনি হয়তো অতটা পরিচিত নন কিন্তু চেষ্টা করলেই আপনি আপনার আশেপাশে এরকম অনেক ঘটনা বা বিশ্বাস খুঁজে পাবেন যেগুলো ম্যান্ডেলা ইফেক্টের চমৎকার উদাহরণ হতে পারে।
গুজব ও ফেইক নিউজের এ যুগে ম্যান্ডেলা ইফেক্টের কেইস বাড়াটাই স্বাভাবিক। সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে মানুষ খবরের সত্যাসত্য নির্ণয় না করেই তা বিশ্বাস করা শুরু করেন। তাই মূল খবর তাদের চোখ এড়িয়ে গেলে ভ্রমটুকুই বিশ্বাস হিসেবে গেড়ে বসতে পারে মানুষের মনে। সুতরাং একজন সচেতন ব্যক্তির উচিত যেকোনো বিষয়ে সঠিক ও স্বচ্ছ জ্ঞান লাভের সর্বোচ্চ প্রয়াস করা।
Feature Image Courtesy: squarespace-cdn.com