সপ্তদশ শতাব্দীর স্কটল্যান্ড। এক অদ্ভুত কিশোরীর কথা ছড়িয়ে পড়ছে লোকের মুখে মুখে। নাম জ্যানেট ডগলাস। মেয়েটি নাকি মানুষের ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে! কাউকে ডাইনীরা আছর করলে সেটাও নাকি বুঝতে ও বলতে পারে।
জ্যানেট থাকত স্কটল্যান্ডের পার্বত্য এলাকায়। তবে প্রথমবারের মত সে আলোচিত হয়ে ওঠে স্কটল্যান্ডের পশ্চিমে একটা ঘটনার সমাধান করে। জর্জ ম্যাক্সওয়েল নামে এক ভদ্রলোক খুব যন্ত্রণা পাচ্ছিলেন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। ধারণা করছিলেন, কেউ হয়ত কালোজাদু-র প্রয়োগ করছে তার উপর। এ সময় জ্যানেট সেখানে ছিল ঘটনাচক্রে। সে বলে দেয় এটা আসলেই ডাকিনীবিদ্যা চর্চার ফল! কোন ব্যক্তিকে হেনস্তা করার জন্য তার চেহারার অনুরূপ করে ছোট ছোট পুতুল তৈরি করত কালো জাদুকরেরা। সেটা কোন না কোনভাবে রেখে দিত তার ঘরে বা বাড়ির অন্য কোথাও। জ্যানেটের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে পুতুলগুলো খুঁজে পান জর্জ ম্যাক্সওয়েল! নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি!
ঘটনাটা লোকমুখে জানাজানি হতেই ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। জ্যানেট আরো একটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের সমাধান করতে সক্ষম হয়। দুটো ছেলে পানিতে ডুবে মারা যায়। সেই ছেলে দুটোর হত্যার পেছনে ডাকিনীবিদ্যার চর্চা কাজ করছে বলে জানায় সে। পরে তার এই ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক প্রমাণিত হয়!
এবারে বিষয়টি এতই সাড়া ফেলে যে, জ্যানেটের বাড়িতে লোকজনের ভিড় সামলানো অসম্ভব হয়ে ওঠে। জ্যানেট একরকম আত্মগোপণে থাকতে শুরু করে।
এই ঘটনাগুলো যখন ঘটছে তখন মেয়েটির বয়স মাত্র এগারো বছর। সে সময়ই একা ভ্রমণ করে গ্লাসগোতে পৌঁছায় সে। কীভাবে কীভাবে যেন চাউর হয়ে যায় তার আগমনের সংবাদ! লোকেদের ব্যাপক ভিড় হতে থাকে তাকে দেখার জন্য। এখানে ঘটে এক কামারের সাথে তার সেই অদ্ভুত ঘটনাটি।
সেই কামার লোকটি যথেষ্ট পরিশ্রমী ছিলো। কিন্তু তবুও তার কাজে উন্নতি হচ্ছিলো না। জ্যানেট বলে যে, তার এক গোপন শত্রু তার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। তার চেহারার একটা মাটির ছোট মূর্তি গড়ে রাখা হয়েছে দোকানের কোথাও! সবটাই আসলে ডাকিনীবিদ্যার ফল। কামার ভালোভাবে খোঁজ শুরু করেন। আর হ্যাঁ, জ্যানেটের কথাকে সত্যি প্রমাণ করে- এরকম একটা মূর্তি দেখতে পান তার দোকানের এক কোণায়!
এরপর উৎসুক মানুষদের ভিড় থেকে জ্যানেটকে নিরাপদ রাখতে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় গ্লাসগোর কারাগারের বিশেষ নিরাপত্তা সেলে। বছরখানেক পর স্কটল্যান্ডের ‘প্রিভি কাউন্সিল’ (রাজাকে পরামর্শ দানের জন্য গঠিত সভা) থেকে তলব করা হয় তাকে। ফলে এডিনব্র-তে যেতে হয় জ্যানেটকে।
ঠিক এই নামেই সে সময় স্কটল্যান্ডে আরেকজন সম্ভ্রান্ত নারী ছিলেন। ডাইনী হবার অভিযোগে রাজা পঞ্চম জেমস এর সময় তাকে পুড়িয়ে মারা হয়। প্রিভি কাউন্সিলের সন্দেহ ছিলো এই মেয়েটিও হয়ত ডাকিনীবিদ্যার চর্চা করছে। কিন্তু সেখানে আত্মপক্ষ সমর্থন করে জ্যানেট বলে যে, সে মূলত তার অতিন্দ্রীয় ক্ষমতার ব্যবহার করছে শয়তানের বিরুদ্ধেই। তবে তা বিশ্বাস করতে চাননি সেখানকার এক আর্চ বিশপ। এরপর জ্যানেট নাকি আঙুলের ইশারায় একটা টেবিল ঘুরিয়ে দেয়! আর ইঙ্গিত করে একজন পাদ্রীর দিকে। বলে এই পাদ্রীকে রাত একটার দিকে অজানা কারো সাথে কথা বলতে শোনা যায়! পরে জানা যায়, পাদ্রীর শয়তান উপাসনার সাথে সংযোগ ছিলো! (এই ঘটনাটা ঐতিহাসিক রবার্ট উডরড এর সূত্রে জানা যায়)
নিরাপত্তার স্বার্থে এখানেও তাকে কারাগারের বিশেষ সেলে রাখা হয়। এখানে জ্যানেটের সাথে দেখা হয় জর্জ হিকস এর। হিকস ছিলেন ডিউক অব লউলিডের এর ব্যক্তিগত ধর্মসচিব। হিকস ধারণা করেছিলেন মেয়েটির হয়ত শয়তান উপাসনা বা ডাকিনীবিদ্যার সাথে কোন সম্পর্ক থাকতেও পারে। তাই তিনি একান্তে তার সাথে কিছু কথা বলেন। এই সবকিছু তিনি চিঠি লিখে পরে জানিয়েছিলেন স্যামুয়েল পেপীস-কে। সেখান থেকেই মূলত পরবর্তীতে বিষয়টা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
হিকস তার কাছে জানতে চান যে, এই অতিন্দ্রীয় ক্ষমতার উপস্থিতি সে কবে থেকে টের পেতে শুরু করেছে? যখন সে কোন ঘটনা সমাধান করে, এর আগে বা পরে কোনসময় কি তার মন অস্থির বা চঞ্চল হয়ে ওঠে? কিংবা কোন সমস্যা কি দেখা দেয়?
জ্যানেট এককথায় বলেছিল তেমন কিছুই ঘটেনা। সেক্ষেত্রে কী করে সে এসব ঘটনার সমাধান করছে তার সুনির্দিষ্ট কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।
স্কটল্যান্ডের পত্রিকা স্কটসম্যান এ সেখানকার এক গণিতবিদ ও গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জর্জ সিনক্লেয়ার অভিমত ব্যক্ত করেন, যাদের এই ভবিষ্যৎদর্শনের ক্ষমতা আছে, কিংবা আছে পানির ওপর দিয়ে হাঁটা বা কৃস্টাল বলে কোনকিছু দেখার ক্ষমতা- তারা কোন না কোনভাবে শয়তানের সাথে যুক্ত!
যা হোক, এতকিছুর পরও জ্যানেটকে শয়তান উপাসনার সঙ্গে কোন না কোনভাবে সম্পৃক্ত বলেই মনে করছিল প্রিভি কাউন্সিল। হিকস জ্যানেটের পক্ষ হয়ে তাদের পারিষদদের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলেন। শর্ত ছিলো প্যারোলে মুক্তি নিয়ে তাকে চিরতরে চলে যেতে হবে ইংল্যান্ডে।
সাথে সম্পর্কিত মনে করা হয়; Image Courtesy: ancient-origins.net
তবে তার আর দরকার হয়নি। ডিউক অব লউলিডের জ্যানেটকে মুক্তি দেন। এরপর আর কোন খোঁজও পাওয়া যায়নি তার। জেলের নিরাপত্তা সেল থেকে বেরিয়ে জাহাজে চেপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দিকে যাত্রা করে সে। ধারণা করা হয়, পরবর্তী জীবন ওয়েস্ট ইন্ডিজেই কাটিয়েছে সে।
কিন্তু সেটাও কেবল ধারণাই। পরবর্তীতে আসলে কী হয়েছিল জ্যানেটের, কোথায় গেল সে, কীভাবে কাটলো তার পরবর্তী জীবন- সেসব কিছুই আর জানা যায়নি। আজও সেসব রয়ে গেছে ইতিহাসের এক অমীমাংসিত অধ্যায় হয়ে।
Feature Image Courtesy: ancient-origins.net
Reference: