দৈত্যটির খুব অহংকার ছিল। তার বিশাল বাগানে কাউকে ঢুকতেই দিতো না সে। কেউ খেলতে গিয়ে ঢুকে পড়লে হুংকার দিয়ে, ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিত সে। এর মাঝে দৈত্যটি বেড়াতে গিয়েছিল তার এক বন্ধুর বাসায়। বন্ধুর নাম কর্ণিশ। কর্ণিশ দৈত্যের বাসায় আমাদের গল্পের এই দৈত্যটি গিয়েছিল সাত-সাতটা বছরের জন্য। ফিরে এসে দেখলো, তার এই সাম্রাজ্যে এসে ঢুকেছে বেশ কয়েকজন বালকের দল। হুংকার দিলো সে। সাইনবোর্ড সাঁটিয়ে দিলো- ‘বাগানে প্রবেশ দণ্ডনীয়।’ চলে গেলো শিশুরাও। এরপর কীভাবে সেই স্বার্থপর দৈত্য পরিণত হলো এক বন্ধুবৎসল দৈত্যে সেটিই আমরা দেখবো আজকের লেখায়।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক অস্কার ওয়াইল্ডের ‘দ্য সেলফিস জায়ান্ট’ গল্পের শুরুটা হলো এভাবেই। ১৮৮৮ সালের মে মাসে গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই ব্যাপক সাড়াও ফেলে দেয়। যা হোক, দৈত্য তো বের করে দিলো সব শিশুদের। তুলে দিলো বিশাল এক প্রাচীর। তারপর একসময় শীত নেমে এলো। বাগান ছেয়ে গেলো বরফে। তারপর এলো ঠাণ্ডা উত্তুরে বাতাস। কাঁপন ধরিয়ে দিলো দৈত্যের শরীরে। তারপর এলো ঝড়। জানালার কপাট যেন উড়ে যেতে চাইলো দমকা বাতাসে।
শীত এসেছে, তো এসেছেই। যাবার আর নাম নেই। দৈত্য ভেবে কুল পায় না কী করবে! আর এমন-ই বা হলো কেন! আশেপাশের সব বাগানে ফুল-ফলের সমাহার নিয়ে এসেছে বসন্ত। সবুজে সবুজে ছেয়ে গেছে মাঠ-ঘাট-বাগান। কিন্তু দৈত্যের বাগানে সেসব কিছুই নেই। শীতের রিক্ততাকে সঙ্গী করেই কেটে যাচ্ছিলো তার দিন।
হঠাৎ একদিন তার মনে হলো যেন খুব সুন্দর একটা গান গাইছে কেউ। তার জানালায় বসে ছিল একটি লিনেট পাখি। সেই পাখিটিই গাইছিল এই সুমধুর গান। আর তারপর বাইরে বেরিয়ে দৈত্য দেখলো, ফুলে-ফলে-সবুজের সমারোহে পূর্ণ তার বাগান! হুট করে কীভাবে হলো এসব? আসলে দেয়ালে তৈরি হয়েছিল ছোট্ট একটা ফাটল। আর সেই ফাটলের ফাঁক দিয়েই ঢুকে পড়েছিল কয়েকজন শিশু। শিশুদের আগমনে প্রাণ ফিরে পেলো প্রকৃতি, গাইলো পাখি, বইলো স্নিগ্ধ বাতাস; আর তার সাথে সাথে ফুলে-ফলে ভরে উঠলো দৈত্যের বাগান।
বোধোদয় হলো স্বার্থপর দৈত্যের। কিন্তু তাকে দেখেই ভয়ে পালিয়ে গেলো শিশুরা। শুধু একটি শিশু দাঁড়িয়ে রইলো। দৈত্যকে সে দেখতে পায়নি। শিশুটি কেঁদেই যাচ্ছিলো দৈত্যের ভয়ে। কিন্তু দৈত্যটি এসে তুলে নিলো তাকে, বসিয়ে দিলো গাছের চূড়ায়। চুমো খেলো তার দুই হাতে–পায়ে।
এই দৃশ্য দেখে বাদবাকি শিশুরাও ফিরে এলো। দেয়াল ভেঙে ফেললো দৈত্য। বললো, ‘আমার বাগানে অনেক সুন্দর সুন্দর ফুল আছে। কিন্তু শিশুরাই সবচেয়ে সুন্দর ফুল।‘
শিশুদের সাথে খেলায় মেতে উঠলো দৈত্য। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল হলো সেই শিশুটি নেই! অন্যদের বলেও কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না। তারা কেউ জানেনা সে কোথায় থাকে, আগে কখনো দেখাও হয়নি তার সাথে অন্য কারো। দৈত্যটি তাদের খুব করে বলে দিলো, যেন অবশ্যই পরেরদিন শিশুটি আসে। কিন্তু সেই শিশুটি আর এলো না।
এরপর দিন বয়ে যেতে থাকে। শিশুদের সাথে প্রতিদিনই খেলত দৈত্য। স্বার্থপর দৈত্য থেকে সে হয়ে উঠেছিল বন্ধু দৈত্য। কিন্তু সেই শিশুটির কথা সে ভুলতে পারেনি। তাকে চুমু খেয়েছিল সে। আদর করে বসিয়েছিল গাছের চূড়ায়। সেই স্মৃতি মাঝে মাঝেই ফিরে আসত তার মনে, বুকের গহীনে বাজিয়ে যেত ব্যথার সুর।
বয়েসের সাথে সাথে একসময় অক্ষম হয়ে পড়ল দৈত্য। এখন সে শুধু চেয়ারে বসে শিশুদের খেলা দেখে, আর অতীত সেই স্মৃতি মনে করে তার হৃদয় ভার হয়ে ওঠে। একদিন সকালে বাগানে বেরিয়ে দৈত্য হঠাৎ দেখলো সেই গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে আছে সেই শিশুটি! হ্যাঁ, সেদিনের সেই শিশুটিই। সেই মুখ, সেই চোখ, সেই মিষ্টি হাসি। কত বছর এর ভেতর পেরিয়েছে তার হিসাব নেই। কিন্তু শিশুটির বয়স যেন একটুও বাড়েনি!
দৈত্য আনন্দে চোখ মুছতে মুছতে এগিয়ে গেলো। তারপর শিশুটির কাছে যেতেই দেখলো তার দুই হাতে,দুই পায়ে লাল দাগ! যেন কেউ মেরেছে তাকে। প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ দৈত্য হুংকার দিলো, ‘বলো, কে আঘাত করেছে তোমাকে? নাম কী তার?’
শিশুটির গলায় যেন কথা বললো অন্য কেউ- ‘এগুলো ভালোবাসার চিহ্ন।’
সমীহ জাগলো দৈত্যের মনে। শিশুটির কাছে জানতে চাইলো, কে তিনি? জবাব এলো, ‘একদিন তুমি আমাকে আমার বাগানে খেলতে দিয়েছিলে, আজ তুমি যাবে আমার বাগানে- যার নাম স্বর্গ।’
বিকেলে শিশুরা খেলতে এসে দেখলো মারা গিয়েছে দৈত্য! গাছটির নিচে শুয়ে আছে সে, সাদা ফুলে ফুলে ভরে আছে তার দেহ।
অস্কাল ওয়াইল্ডের এই গল্পটি মূলত একটি ফ্যান্টাসি ঘরানার গল্প। গল্পের দৈত্য একদিন সেই শিশুরূপী দেবদূতকে ভালোবেসেছিল, তার জন্য পরবর্তী জীবনটা কাটিয়েছিল অপেক্ষায়; গল্পের শেষে সেই দেবদূত এলো, তাকে চিরদিনের মত সঙ্গী করে নিয়ে গেলো স্বর্গের বাগানে।
মূলত, গল্পটিতে লেখক এটাই দেখাতে চেয়েছেন, কোন একসময় কাউকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসলে তা আবার ফিরে আসেই কোন না কোন রূপে, এই পৃথিবীতে অথবা অন্য কোথাও। প্রকৃত ভালোবাসা টিকে থাকে অজর-অমর হয়ে।
Feature Image Courtesy: ssaranmani.blogspot.com