অনেক অনেক বছর আগে সবাই মনে করত পৃথিবী সমতল। কারণ এটি দেখতে সমতল। যখন আমরা সমুদ্রের মাঝখানে নৌকার মধ্যে থাকব তখন আমাদের অবস্থান থেকে প্রত্যেক দিকে পানি কে আমরা সমতল অবস্থায় দেখব। যেখান থেকে ধারণা করা যায় যে সমুদ্র একটি বাটির মতো যার উপরে আকাশ অবস্থান করে। যেখানে পানি এবং আকাশ মিলিত হয় তাকে ‘দিগন্ত’ বলে। যদি নিজেকে কেন্দ্রে মনে ধরা হয় তবে দিগন্ত কে দেখতে বৃত্তের মত লাগে।
যদি তুমি স্থলভূমিতে থাক তখন আর দিগন্ত রেখা কে বৃত্তের মত দেখতে লাগবে না। তখন আকাশ আর স্থলভূমির মিলন স্থান অর্থাৎ দিগন্ত হবে উঁচু নিচু। এর কারণ পাহাড়, গাছপালা, বাড়ি ইত্যাদি বস্তুর অবস্থান হয় স্থলভূমিতে।
কিছু প্রাচীন মানুষের চিন্তা এমন ছিল যে, পৃথিবী অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত। তারা ভাবত পৃথিবী হলো ভূমি ও সমুদ্র বিশিষ্ট এক বিশাল সমতল যার কোনো শেষ নেই অর্থাৎ অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত!
যদি এরকমটাই হবে তবে সূর্যের ব্যাপার টা কী? এটি ভোরে উদিত হয় এবং সন্ধ্যায় অস্ত যায়। পরের দিন আবার পূর্ব দিক হতে উদিত হয়।
কতিপয় প্রাচীন মানুষ এই বিষয়টি বোঝাবার চেষ্টা করেছেন এভাবে যে, প্রত্যেক দিন সকালের নতুন সূর্য উদিত হয়ে সারা আকাশ ভ্রমণ করে যখন অস্ত যায় তখন এটি ধ্বংস হয়ে যায়।

আরেকদল মানুষ বলতো সূর্য পশ্চিমে অস্ত যায়। তারপর এটি একটি নৌকায় করে সমুদ্রের মধ্য দিয়ে পশ্চিম দিকে সারারাত ধরে গমন করে পূর্ব দিকে পৌছায়। অতঃপর সকালে উদয় হয়।
তারপরও অন্য অনেকে ভাবত সূর্য একটি স্বর্ণের উজ্জ্বল বাহন যা উড়ন্ত ঘোড়ার মাধ্যমে আকাশে উড়তে পারে। সকালে সূর্য দেবতা বাহনে করে পূর্বে পৌছায়। পূর্ব থেকেই যাত্রা শুরু করে আকাশের উপরের দিকে এবং ঠিক মধ্য দুপুরে সে আকাশের শীর্ষে অবস্থান করে। এই বাহনটি নিচের দিকেও ভ্রমণ করতে পারে। এটি দুপুরে নিচের দিকে যাত্রা শুরু করে এবং সন্ধ্যায় পশ্চিমে পৌছায়। সন্ধ্যায় অস্ত যায়। রাতে কোনও এক উপায়ে সূর্য দেবতা বাহনে করে পূর্বে ভ্রমণ করে কোনও প্রকার আলো নির্গত না করে। ভোরে পূর্ব দিকে পৌছায় এবং আবার যাত্রা করে!

যে সকল তারা নর্থ স্টার (North Star) হতে দূরে অবস্থিত তাদের গমন পথ হলো বৃত্ত। এসকল তারাও পূর্ব হতে উদিত হয়ে পশ্চিমে অস্ত যায়।
চাঁদও পূর্বে উদিত হয় এবং পশ্চিমে অস্ত যায়। এই তারা, চাঁদ এর গমন সম্পর্কে কোনও ব্যাখ্যা প্রাচীন মানুষদের থেকে পাওয়া যায় নি। তারা এদের সম্পর্কে কিছুই আলোকপাত করেন নি!
মনে করি আমাদের একটি সমতল পৃথিবী আছে যার চতুর্দিকে বিস্তৃত। এই সমতল পৃথিবীর গভীরতা কত? মনে করুন আপনি একটি বিশাল গর্ত খোঁড়া শুরু করলেন এর শেষ কোথায়? আপনি কি সারাজীবনই গর্ত খুঁড়ে যাবেন অনির্দিষ্ট ভাবে? এর কি কোনো শেষ নেই?
অথবা পৃথিবী কি একটি পাথরের মতো? যার পুরুত্ব নির্দিষ্ট যেমন এক মাইল বা দশ মাইল বা পঞ্চাশ মাইল। যদি তাই হয় তবে কেন এটি নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছে না?
প্রাচীন কালে ভারতীয়রা এই প্রশ্নের উত্তরের ব্যাখ্যা এভাবে করেছিলেন যে, পৃথিবী নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছে না কারণ এটি একটি বিশাল হাতির উপর দাড়িয়ে আছে!
কিন্তু হাতিটি কিসের উপর দাড়িয়ে আছে? তারা এর উত্তরে বলেছিলেন হাতিগুলো বিশাল দৈত্যাকার কচ্ছপের উপর দাঁড়িয়ে আছে!
কিন্তু কচ্ছপগুলো কিসের উপর দাঁড়িয়ে আছে? তারা এর উত্তরে বলেন যে কচ্ছপগুলো বিশাল বিস্তৃত সমুদ্রে সাতার কাটছে!!! আচ্ছা মেনে নেওয়া হলো! তবে সমুদ্র কি সব দিকে সমান ভাবে প্রসারিত? এর উত্তরে তারা কিছু ব্যাখ্যা করতে পারেন নি!

যদিও আপাত দৃষ্টিতে পৃথিবী দেখতে সমতল তবে এটিকে চট করে সমতল বলে ধরে নেওয়া ঠিক হবে না! সমতল পৃথিবী বলে দিলে অনেক প্রশ্ন আসে যার উত্তর দিতে গেলে আটকে যেতে হয়! পৃথিবীকে সমতল বলার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে!
এই সমস্যাগুলো তখন যারা বুঝেছিলেন তারা হলেন গ্রিক। তারা পঁচিশ হাজার বছর পূর্বে বর্তমানের তুর্কির পশ্চিমে বাস করতেন! তাদের মধ্যে একজনের নাম এনাক্সিম্যান্ডার। তিনি সূর্য দেবতা, স্বর্ণের বাহন, উড়ন্ত ঘোড়া সম্পর্কিত গল্পগুলিতে বিশ্বাস করতেন না। তিনি রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করতেন তিনি আসলে কী দেখছেন?
এইরকম এক রাতের পরিষ্কার আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি লক্ষ্য করলেন একটি তারা এক জায়গাতেই আছে। এর অবস্থানের কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না। এই তারাটিই ছিল নর্থ স্টার (North Star)। এটি সারারাত উত্তরের আকাশের একটি নির্দিষ্ট স্থানে স্থির অবস্থায় ছিল।
এটি রাতের পর রাত একই অবস্থানে থাকে। এর আশে পাশের তারাগুলি একে কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে আবর্তন করে। যদি তারাগুলি নর্থ স্টারের খুব কাছাকাছি থাকে তবে এগুলি ছোট ছোট বৃত্ত রচনা করে আবর্তন করে আর দূরে অবস্থান করলে বিশাল বিশাল বৃত্ত রচনা করে আবর্তন করে।
এনাক্সিম্যান্ডার এর নিকট রাতের আকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল তারাগুলির আবর্তনের মধ্যে নির্দিষ্ট প্যাটার্ন বা মিল। তারা কোনো মৌমাছির পালের মত করে অবস্থান করছিল না যেখানে প্রত্যেক মৌমাছি নির্দিষ্ট পথে আবর্তন করে। সকল তারা একত্রে ভ্রমণ করে। এনাক্সিম্যান্ডার সিদ্ধান্ত নেন আকাশ একটি বিশাল ফাকা স্থান বা ‘গোলক’। আকাশের গোলকের চারপাশে অদৃশ্য রেখা বা ‘অক্ষ’ আছে। এর অক্ষের এক প্রান্তবিন্দু নর্থ স্টারে ও অন্য প্রান্ত বিন্দু ঠিক তার বিপরীতে যা সে দেখতে পারছে না। প্রত্যেকদিন গোলকটির পরিমণ্ডল আবর্তন করে। চাঁদ, সূর্য এবং তারাগুলো আকাশে নির্দিষ্ট স্থানে আটকে আছে এবং গোলকের পরিমণ্ডলটি আবর্তনের ফলে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন হয়। একারণেই এগুলি উদিত হয় ও অস্ত যায়। আকাশ গোলক হলেও পৃথিবী সমতল হতে পারে।এনাক্সিম্যান্ডার ভেবেছিল পৃথিবী গোলক আকাশের কেন্দ্রে অবস্থিত।

আকাশের পরিমণ্ডল চলমান থাকে যার ফলে সূর্যোদয় হয় এবং সূর্যাস্ত হয়। পরিমণ্ডলের এই চলনের মাধ্যমে এপাশে যখন সূর্য অস্ত যায় তখন পৃথিবীর অপর পাশে সূর্য উদিত হয়। যার ফলে এইপাশে যখন রাত তখন অপর পাশে দিন! সারারাত ধরে সূর্য গমন করে পূর্বে পৌছায় আবার সকালে উদিত হয়।
এখানে এই ধারণাটি আগের গল্পগুলির থেকে বেশি গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিযুক্ত।
Feature Image Courtesy: oceanservice.noaa.gov
Reference:
- How did we find out the earth is round, Issac Asimove