সকল মানুষ পৃথিবী গোলক মেনে নেয়ার পরে যে প্রশ্নটা সবার আগে মানুষের মাথাতে এসেছে তা হলো: পৃথিবী কত বড় গোলক? অর্থাৎ পৃথিবীর আসল আকার কতখানি?
পৃথিবীর আকার নিয়ে যত জল্পনা কল্পনা: পৃথিবীর আকার কি তবে গোলক? (চতুর্থ পর্ব) পড়তে এখানে ক্লিক করুন
একটি উপায় হতে পারে- একজন মানুষ নির্দিষ্ট বিন্দু হতে যাত্রা শুরু করে পুরো পৃথিবী ভ্রমণ করে যাত্রা বিন্দুতে ফিরে আসার সময় সে কতখানি জায়গা ভ্রমণ করল তার হিসেব রাখা! কেউ একজন চাইলে এভাবে পৃথিবীর আকার পরিমাপ করতে পারে।
কিন্তু এটি প্রায় অসম্ভব ব্যাপার ছিল। কেননা একজন মানুষ যেদিকেই যাত্রা শুরু করুক না কেন তাকে একসময় সমুদ্রের সামনে পড়তে হবেই! অর্থাৎ তাকে সমুদ্র যাত্রা করতেই হবে। সমুদ্র যাত্রার জন্য তখন মানুষের প্রয়োজন ছিল একটা জাহাজের। কিন্তু গ্রীকদের নিকট তখন জাহাজ ছিল না অর্থাৎ এভাবে পৃথিবীর আকার পরিমাপ করা প্রায় অসম্ভব ছিল!
তখন তারা ভেবেছিল যে কোনোভাবে কি বাড়িতে বসেই পৃথিবীর আকার জানা সম্ভব? ইরাস্টোনিস নামের একজন গ্রীক দার্শনিক ২৪০ খ্রিষ্টাব্দে এমন একটি উপায় খুঁজে বের করেছিলেন।
যদি পৃথিবী গোলক হয় তবে সূর্যের রশ্মি বিভিন্ন কোণে পৃথিবীতে অপতিত হবে। ধরুন আপনি পৃথিবীর এমন অংশে অবস্থান করছেন যেখানে একটি নির্দিষ্ট সময়ে সূর্য সরাসরি লম্বভাবে অপতিত হয়। কিন্তু পৃথিবীর পরিসীমা বক্র! তাই অবশ্যই আপনার থেকে শত মাইল দূরে ঐ নির্দিষ্ট সময়ে সূর্য রশ্মি অপতিত হচ্ছে তীর্যকভাবে। ঐ স্থানে তৈরি হওয়া আপনার ছায়া থেকে ঢাল বাঁ কতখানি তির্যক তা নির্ণয় করতে পারেন।
যদি একটি খোলা মাঠে একটি লম্বা কাঠি লম্বভাবে রাখা হয় তবে কিছু ব্যাপার ঘটতে দেখা যায়। যখন সূর্য রশ্মি সরাসরি কাঠির ওপর লম্বভাবে পড়ে তখন কাঠির কোনো ছায়াই পড়ে না, আবার যখন অল্প তীর্যকভাবে পড়ে তখন ছায়া ছোট হয় এবং যখন আলোক রশ্মি বেশি তির্যক ভাবে পড়ে তখন ছায়া বড় হয়।
এখন যদি এই কাঠিকেই দুই ভাগ করে একটি আগের স্থানে ও অন্যটি সেখান থেকে ৫০০ মাইল দূরে রাখা হয় তবে যখন প্রথমটার ওপর আলোক রশ্মি সরাসরি পড়ে তখন ঐ নির্দিষ্ট সময়ে প্রথমটাতে কোনো ছায়া তৈরি না হলেও দ্বিতীয় কাঠিতে ছোট ছায়া তৈরি হয় কারণ আলো খুব অল্প তীর্যকভাবে পড়েছে!
যদি পৃথিবী অনেক বড় গোলক হয় তবে ৫০০ মাইলে খুব সামান্যই বক্র হবে। আর যদি পৃথিবী ছোট গোলক হয় তবে ৫০০ মাইলে বক্রতার পরিমাণ হবে বেশি যার ফলে কাঠির ছায়াও পড়বে বড় আকারের। আর বিশাল গোলক হলে বক্রতার পরিমাণ হবে কম এবং কাঠির ছায়াও হবে ছোট।
জ্যামিতিতে দুটি ভিন্ন স্থানের ছায়ার দৈর্ঘ্য পরিমাপ করে পৃথিবী নামক গোলকের আকার নির্ণয় করা সম্ভব।
ইরাস্টোনিস বলেছিলেন যে ২১ জুন হলো সবচেয়ে বড় দিন। কারণ মিশরের সিন শহরে ২১ জুন দুপুরে কোনো কাঠির ছায়া পড়ে না। একেবারেই ছায়া পড়ে না! ইরাস্টোনিস মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে কাজ করতেন। সিন থেকে আলেকজান্দ্রিয়া ৫০০ মাইলের দূরত্ব। তিনি জানতেন ঐ দিন আলেকজান্দ্রিয়াতে ঐ সময় একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের ছায়া পড়ে। তিনি এও জানতেন যে সিন থেকে আলেকজান্দ্রিয়া ৫০০ মাইলের দূরত্ব।
এই তথ্যগুলি থেকে তিনি নির্ণয় করলেন পৃথিবীর আকার! তিনি বের করলেন যে পৃথিবীর পরিধি আসলে ২৫,০০০ মাইল এবং পৃথিবীর ব্যাস ১৮,০০০ মাইল প্রায়! এটিই প্রাচীন গ্রীকদের মধ্যে পৃথিবীর আকার সম্পর্কে সবথেকে ঠিকঠাক তথ্য!
১৫০ অব্দে এসে টলেমী নামের একজন গ্রীক জ্যোতির্বিদ একটি বই লিখেন ভূতত্ববিদ্যা সম্পর্কিত। সেখানে তিনি একটি ছোট চিত্র ব্যবহার করেন। এই বই পরের এক হাজার বছর সকল মানুষ এবং বিজ্ঞ ব্যক্তিরা অন্ধের মত বিশ্বাস ও অনুসরণ করেছেন। তারা বিশ্বাস করতেন টলেমী সঠিক ছিল। ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দে এসে পৃথিবীর প্রকৃত আকার জানতে পারাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছিল। পশ্চিম ইউরোপের মানুষ পূর্ব দিকে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য সম্প্রসারিত করতে চাইছিল। তারা ভারত, চীন, জাপান ও দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপগুলির সাথে বাণিজ্য করতে চাচ্ছিল। এদেরকে একসাথে বলা হত ‘ভারতবর্ষ’।
ভারতবর্ষে সিল্ক, মসলা সহ এমন সব উপাদান ছিল যা ইউরোপিয়ানদের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ভারতবর্ষে আসার কোনো সহজ উপায় ছিল না। কেউ চাইলে স্থলভূমি ব্যবহার করে হাজার মাইল ভ্রমণ করে পৌছাতে পারতো। তবে ঐসময় স্থলভূমিতে যাত্রা মোটেই সহজ ছিল না! কারোর পক্ষেই এতোটা রাস্তা এভাবে যাত্রা করা সম্ভব ছিল না।
সম্ভবত সমুদ্র ব্যবহার করলে ভারতে পৌঁছানো সহজ হতো। কিন্তু কেউ জানতো না কীভাবে সমুদ্র যাত্রার মাধ্যমে ভারতে পৌঁছানো যায়! একটি সম্ভাব্য উপায় ছিল আফ্রিকা দিয়ে যাত্রা করা। কিন্তু কেউ আফ্রিকার আকার সম্পর্কে অবহিত ছিল না। ১৪১৮ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগাল জাতি জাহাজ পাঠায় আফ্রিকা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত ভাবে সব কিছু জানার জন্য। প্রায় সত্তর বছর পর ১৪৮৭ সালে পর্তুগিজ পরিবার জাহাজে করে দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌছায়। একজন ইতালীয় পরিব্রাজক ক্রিজ টফার কলম্বাস আবিষ্কার করেন যে দক্ষিণ আফ্রিকা দিয়ে যাওয়ার রাস্তাটা অনেক বেশি বড়। এর থেকে উত্তরে গেলে সহজে ও তাড়াতাড়ি ভারতে পৌঁছানো সম্ভব। সম্ভবত এইদিকে একটি কম দূরত্ব পেরিয়ে ভারতে পৌঁছানো সম্ভব।
ইউরোপের পশ্চিম থেকে এশিয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রায় হাজার মাইলের দূরত্ব ছিল। সম্ভবত এখানে একটা বক্রতা ছিল। তারা প্রায় কাছাকাছিই চলে গিয়েছিল! এই ক্ষেত্রে ইউরোপের পশ্চিম থেকে এশিয়ার দিকে এই পথে যাত্রা বেশি সহজ ও দ্রুত হতো না?
ইরাস্টোনিসের কথা মতে পৃথিবীর পরিধি ২৫,০০০ মাইল এবং স্থলপথে পশ্চিম ইউরোপ থেকে ভারতের দূরত্ব প্রায় ৯,০০০ মাইল। এই ক্ষেত্রে কলম্বাসকে প্রায় ১৬,০০০ মাইল পশ্চিমে ভ্রমণ করতে হতো এশিয়াতে পৌঁছানোর জন্য। ঐ সময়ে এইরকম কোনো জাহাজ ছিল না যা এতোটা পথ ভ্রমণ করার মতো।
কিন্তু ধরুন পৃথিবীর পরিধি মাত্র ১৮,০০০ মাইল যেমনটা টলেমী বলেছিল এবং পশ্চিম ইউরোপ থেকে স্থলপথে ভারতের দূরত্ব ১২,০০০ মাইল। এখন ভারতে পৌছাতে মাত্র ৬,০০০ মাইল ভ্রমণ করতে হবে! পশ্চিম ইউরোপের সমুদ্রে ও পূর্ব এশিয়ার সমুদ্রে অনেক দ্বীপ রয়েছে সেগুলো গণনা করলে মাত্র ৩,০০০ মাইল সমুদ্রে ভ্রমণ করলেই ভারতবর্ষে পৌঁছানো সম্ভব ছিল।
কলম্বাস স্পেনের সম্রাট ও রাণী কে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে ভারতের দূরত্ব মাত্র ৩,০০০ মাইল এবং সে চাইলেই ভ্রমণে বের হতে পারে। সে ১৪৯২ সালের আগস্টে ভারতের উদ্দেশ্যে তিনটি জাহাজ নিয়ে যাত্রা শুরু করেন।
কিন্তু যা হবার তাই হলো। কলম্বাস ভুল ছিল। ভারতবর্ষ তিনি যত দূরে ভেবেছিলেন তার থেকে অধিক দূরে ছিল। তিনি জানতেন না যে ভারত ও ইউরোপের মাঝেও অনেক মহাদেশ আছে।
১৪৯২ সালের ১২ ই অক্টোবর কলোম্বাস একটি দ্বীপে পৌঁছায় যা দেখে তিনি ভেবেছিলেন যে ভারতের খুবই কাছাকাছি তিনি আছেন। তিনি আরও যাত্রা করেন এবং বড় দ্বীপে পৌঁছান যাকে এখন ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ বলা হয়। যা একমাত্র কলম্বাসের ভুলের জন্যেই! কলম্বাস ঐ দ্বীপের মানুষদের ‘ইন্ডিয়ান’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।
যদিও কলম্বাস বিশ্বাস করতেন যে তিনি ভারতবর্ষে পৌঁছে গিয়েছেন কিন্তু ১৫০৬ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুর পর অন্যদের মনে হয়েছিল তারা আসলে ভারতবর্ষে পৌঁছান নি। সেখানে আসলে কিছুই মিলছিল না আগের দেওয়া বর্ণনার সাথে যেগুলি চায়না ভ্রমণকারীরা দিয়েছিল।
কিছু মানুষ ভাবতো যে কলম্বাস যে জায়গা আবিষ্কার করেছিল তা আসলে ছিল নতুন মহাদেশ। তারপরে ১৫০৭ সালে জার্মান ফটোগ্রাফার ভেসপিসিয়াস বলেন যে তারা ঠিকই নতুন মহাদেশ আবিষ্কার করেছিল। নতুন এই মহাদেশের নামকরণ করা হয় আমেরিকা।
এই সময়ের মধ্যে পর্তুগিজরা আফ্রিকা দিয়ে ভ্রমণ করে ভারতবর্ষে পৌঁছে যায়। আর এইদিকে স্পেন মাত্র নতুন এক মহাদেশ আবিষ্কার করতে সক্ষম হয় যা ভারতের মত সমৃদ্ধ ছিল না।
স্প্যানিশদের মধ্যে একজন পরিব্রাজক স্পেনে ফিরে যান এবং সেখানের রাজাকে গিয়ে বলেন একমাত্র পশ্চিম আমেরিকা দিয়েই ভারতে যাওয়া সম্ভব পর্তুগিজদের সাথে যুদ্ধ না করে। ১৫১৯ সালে এই পরিব্রাজক ম্যাগেলান পশ্চিম আমেরিকা পৌঁছান এবং একটি সরু প্যাসেজ খুঁজে বের করে পূর্ব দিকে আসতে থাকেন ৫ টি জাহাজ নিয়ে। এই সরু প্যাসেজ কে সেই সময়ে ‘স্ট্রেইট অফ ম্যাগেলান’ বলা হতো।
এইদিকে ভ্রমণ করে সে একসময় একটি নতুন সমুদ্রে এসে পড়েন। সমুদ্রটি খুবই শান্ত এবং বিশাল। সমুদ্রের নামকরণ করেন ‘প্যাসিফিক’। তারা প্রায় ৯৯ দিন কোনো দ্বীপ বা ভূমি দেখা ছাড়াই ভ্রমণ করেন। যার ফলে জাহাজের মানুষদের মৃতপ্রায় অবস্থা হয়ে যায়। এমন সময় তারা একটি দ্বীপপুঞ্জের সন্ধান পায় এবং সেখানে তারা বেঁচে যায়। পরে জাহাজগুলি ফিলিপাইনে পৌছায়। ম্যাগালিনের এই যাত্রাই ছিল প্রথম যাত্রা যা পুরো পৃথিবী ভ্রমণ করতে পেরেছিল।
বর্তমান সময়ে আমরা জানি পৃথিবী দেখতে আসলে কেমন। চাঁদ থেকে আমরা দেখেছি যে পৃথিবী আসলে গোল। কিন্তু প্রায় ২৫০০ বছর পূর্বে প্রাচীন গ্রীকরা শুধুমাত্র তারা, চাঁদ, সূর্য দেখে হিসেব করেই বলে দিয়েছিল পৃথিবী গোল।
Feature Image Courtesy: quora.com
Reference: How did we know the earth is Round? Issac Asimove