গোঘ্ন: পালিত পশুর সন্তানসম হয়ে ওঠার গল্প

‘চারু মাস্টারের বেহালা শুনে দোলাই বড় কেঁদেছিল। দোলাই ছিল নরম মনের ছেলে।’ সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের বিখ্যাত গল্প গোঘ্ন-র শুরুটা হয় এভাবেই।

বৈদিক যুগে বাড়িতে অতিথি এলে তাদের আপ্যায়ন করা হতো গরুর মাংস আর মধু দিয়ে। এ রীতির নাম ছিলো গোঘ্ন। এটা ছিল অতিথিদের জন্য বিশেষ সম্মানের পরিচায়ক। গরুর মাংস না থাকলে তা অতিথিদের প্রতি একরকম অপমান হিসেবেই দেখা হতো। ‘গোঘ্ন’ গল্পে মূল চরিত্র হারাইকেও আপ্যায়ন করা হয়েছিল গরুর মাংস দিয়ে। কিন্তু মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও হারাই কি তাতে খুশি হতে পারল?

এসব আমরা জানব। তার আগে চলুন ফিরে যাই গল্পের শুরুতে। দোলাই চারু মাস্টারের বেহালা শুনে বেশ কেঁদেছিল। তার নরম মনে ছাপ ফেলে গিয়েছিল সেই সুর। চারু মাস্টারকে সে কথা দিয়েছিল তার মেয়ের বিয়েতে নিজেদের গাছের কুমড়ো দিয়ে যাবে। কিন্তু দোলাইয়ের সেই সৌভাগ্য হয়নি। তার আগেই কবরে চলে গিয়েছে সে, ঘুমোচ্ছে চিরদিনের মত।     

‘গোঘ্ন’ গল্পের লেখক সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ; Image Courtesy: bdnews24.com

ভাইয়ের দেয়া কথা রাখতেই তার বড় ভাই হারাই এসেছে চারু মাস্টারদের বাড়ি। ফাগুন মাসে মাস্টারের বেটির বিয়ে। চারু মাস্টার রাঢ় অঞ্চলের মানুষ। তারা বারো মাস চমৎকার মিহি লাল চালের মিষ্টি ভাত খান। হারাই এসেছে কুমড়ো দিতে। বিনিময়ে নিয়ে যাবে ধান। তাদের দেশে ছাতু বা রুটি খেয়ে থাকে মানুষ। পৌষে আউশের মোটা ধান থেকে কখনো-কখনো একটু ভাত খেতে পায় তারা। এই লাল মিহি চালের ভাত যেন তাদের কাছে শাহদানা অর্থাৎ রাজার খাদ্য

তিনবস্তা ধান নিয়ে আর মাস্টারের মেয়ের কাছ থেকে বিয়ের নিমন্ত্রণ নিয়ে ফিরতি পথ ধরেছিল হারাই। তার হাল দেয়ার দুটো গরু। ধনা আর মনা। বাঁ দিকের গরুটা অর্থাৎ, ধনার অবস্থা বিশেষ ভালো না। ছ্যারানী হয়েছে সারা গায়ে। মাস্টারের পরামর্শে তাকে নিয়ে পরিমল কবিরাজের কাছে যায় হারাই।

হারাই মুসলিম। এই গাঁ হিন্দুপ্রধান। তারা এখানে এলে সাধারণত হিন্দুবাড়িতে কিছু খেতনা। তার ভাই দোলাইয়ের এসব বিচার ছিল বিশেষভাবে। কিন্তু মাস্টার বেহালা আর গ্রামের মেলা দেখতে দেখতে, আসা-যাওয়া করতে করতে এসব সংস্কার ভেঙে গিয়েছিল। তাই কবিরাজ পরিমলকে গরু দেখাতে বা তার মন্ত্রপূত পানি নিতে হারাইয়ের আপত্তি হয়নি। 

গল্পে হারাইয়ের বামদিকের গরু ধনা অসুস্থ হয়ে পড়ে; Image Courtesy: prothomalo.com

গরু দেখাতে এসে ধনা-মনাকে যে গাছটার নিচে রেখেছিল হারাই, সেখানে অনেক আগে ফাঁস দিয়েছিল ইসমিল। এসব শুনে অমঙ্গল চিন্তা মাথায় আসে তার। গ্রামের মানুষদের অনেকের ভূত নিয়ে এমন নানা বিশ্বাস থাকে। তার প্রতিফলন আমরা এখানে দেখতে পাই।

ধনার হাঁটতে কষ্ট হওয়ায় হাল নিজের কাঁধে তুলে নেয় হারাই। সন্তানসম ধনাকে সে কষ্ট দিতে চায়না। তাকে বলতে শোনা যায় যে, ‘কলিমদ্দিআসিরদ্দি যেমন তার ব্যাটা, এই ধনামনাও তাই

নির্জন শীতের রাতে একা দুটো গরু নিয়ে পথ চলতে চলতে তার মনে নানারকম চিন্তা খেলতে থাকে। মৃত ভাই দোলাই স্মৃতিতে হানা দেয়, ইসমিলের মতো আত্মহত্যায় মরা ভূত কিংবা বাড়ির দোরগোড়ায় তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা বউ-ছেলেদের কথা তার মনে পড়তে থাকে। গাড়িতে থাকা তিন বস্তা চাল যেন তিন বস্তা সোনা! মিহি লাল চালের ভাত, শাহদানা!

এক পর্যায়ে দেখা যায়, হারাই এর সাথে দিলজানের সাক্ষাৎ ঘটতে। দিলজানের সালাম শুনে হারাই নিশ্চিন্ত বোধ করে। যাক, তার একজন জাত-ভাই পাওয়া গেলো বটে। এবার আমরা জানতে পারি, হারাইয়ের পুরো নাম হারুন আলী। দিলজান তাকে সোজাসুজি বলে দেয় যে গরু আজ রাত টিকবে না, সে লিখে দিতে পারে!

সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের শ্রেষ্ঠ গল্প সমগ্রেও রয়েছে ‘গোঘ্ন’ গল্পটি; Image Courtesy: goodreads.com

দিলজান তাকে তিরিশ টাকার প্রস্তাব দেয়। সেটা বাড়তে-বাড়তে পঞ্চাশ টাকায় ওঠে। কিন্তু না, যে ধনা হারাইয়ের কাছে সন্তানসম, তাকে বেচতে পারেনা সে।

দিলজান গাল-মন্দ করতে করতে চলে যায়। রাত পেরিয়ে ভোর আসে। আগের দুই ওয়াক্ত নামাজ কাযা হয়েছে হারাইয়ের। কখনও নামাজ কাযা করেনা সে, কপালের কালো দাগটি তার সাক্ষ্য বহন করছে।

ফজরের নামায পড়ে হারাই পরওয়ারদিগারের কাছে দোয়া করে। তার নিজের সন্তানের অভাব নেই। দোয়া করে যেন নিজের কোন এক পুত্রের বিনিময়ে হলেও পরোয়ারদিগার ধনাকে বাঁচিয়ে দেন!

এমন চাওয়ার পেছনে কাজ করে ক্ষুধা নিবারণের বিষয়টিও। একটা হালের বলদ মরলে সেটা কেনার মত অর্ধেক টাকাও নেই হারাইয়ের। কিন্তু নিজের ব্যাটা ধনাকে কিছুতেই বেচতে পারবে না সে। সকাল হয়। ধনার অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। মানুষজন পরামর্শ দেয় গরু বেচে দেয়ার। দিলজানকে এসময়ে আবার দেখা যায়। তিরিশ টাকা দিয়ে শেষপর্যন্ত গরুটা কিনেই নেয় সে।

হারাইয়ের কাছে চাষের বলদ ধনা-মনা ছিলো সন্তানসম; Image Courtesy: banglatribune.com

সেদিন ঘটনাচক্রে বদর হাজির সাথে দেখা হয়ে যায় হারাইয়ের। বদর হাজি খুব সম্মানী মানুষ, অতিথিদের খাতির-যত্ন করেন খুব। দুপুরে খেয়ে রাতে আরো কিছু গাড়িয়ালদের সাথে যেতে বলেন হারাইকে।

হারাই খেতে বসেছিল। হাজি সাহেব নিজেই মৌলবি সাব আর হারাইয়ের পাতে তরকারি তুলে দিলেন। গরুর মাংসের তরকারি। কথায় কথায় বলেও ফেললেন দিলজানের থেকে নিয়েছেন গরুটা। হালাল জবাই।

হারাই তখন কেবল মাংস মুখে দিয়েছে। চিৎকার করে গুঙিয়ে উঠলো সে। হাজি সাহেব ভেবেছিলেন হয়ত এখানকার অনেক কৃষকের মত সে পরোজী (গরু খায়না)।  হারাই তখন পশুর মত চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে, ‘হেই হাজিসাব, হামাক হারাম খাওয়ালেন? হামাক হামার ব্যাটার গোস্ত খাওয়ালেন!’

ধনাকে জবাই করে গরুর মাংসের তরকারি রান্না করা হয়; Image Courtesy: fineartamerica.com

মৌলবি ভীষণ চটে যান। হালালকে যারা হারাম বলে তাদের বেত দিয়ে চল্লিশ ঘা দেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু হারাইয়ের মন তখন ভেঙে-চুরে টুকরো-টুকরো হয়ে গেছে। তার আর্তনাদের কাছে অন্য সব কিছুই চাপা পড়ে যেতে থাকে।

সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের এই গল্পে পালিত পশু একজন কৃষকের কাছে সন্তানসম হয়ে উঠেছে। এই বন্ধন একজন কৃষককে পরিণত করেছে তার হাল-চাষের বলদের পিতায়। তাই সন্তান হারালে যে শোক তার হতো, তা-ই দেখা যায় তার গরু ধনাকে হারানোর পর। গরুর মাংস নিয়ে হারাইয়ের আপত্তি ছিল না, কিন্তু ধনা তো তার কাছে শুধু একটা পালিত গরু ছিল না, সে ছিল তার সন্তান।

Feature Image Courtesy: newsviews.media