আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে যা বুঝতে পারি তা হলো মহাবিশ্ব পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ, সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্র এবং চাঁদ নিয়ে তৈরি।
কিন্তু এটিই কি সব? আমরা কেবল একটি পৃথিবী, একটি সূর্য ও একটি গ্রহ সম্পর্কে জানি। আমাদের দৃষ্টির আড়ালে আরও গ্রহ কি থাকতে পারে? আমাদের দৃষ্টি সীমার বাইরে আরো সূর্য, চাঁদ কিংবা গ্রহ কি থাকতে পারে না?
হল্যান্ডে ১৯০৮ সালে প্রথম টেলিস্কোপ আবিষ্কৃত হয়। মানুষ টেলিস্কোপের সাহায্যে সাধারণ দৃষ্টিসীমা অতিক্রম করতে পারে।
ইতালিয়ান বিজ্ঞানী গালিলিও (১৫৬৪-১৬৪২) একটি ছোট টেলিস্কোপ আবিষ্কার করেন। তিনি এর মধ্যে দিয়ে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করেন। সে প্রায় সময়ই যখন আকাশের দিকে তাকাতো তখন একটি নির্দিষ্ট জায়গায় অনেকগুলো তারা দেখতে পেত।
গালিলিও হঠাৎ করে ১৬১০ সালে টেলিস্কোপের মাধ্যমে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ করেন। টেলিস্কোপ ছাড়া খালি চোখে দেখলে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি দেখতে অনেকটা আলোর কুয়াশার মতো লাগে। গালিলিও টেলিস্কোপের কুয়াশার মাঝে নক্ষত্র বাঁ তারার বিশাল সমাহার দেখতে পান। গালিলিও একই বছর জুপিটার দেখতে পান এবং জুপিটারের চারপাশে ঘূর্ণায়মান চারটি ছোট বস্তু দেখতে পান। এই বস্তুগুলো জুপিটারের উপগ্রহ ছিল। যেমনটা চাঁদ পৃথিবীর উপগ্রহ। এর মানে হলো সৌরজগতে আরও বস্তু আছে যাদের খালি চোখে দেখা যায় না।
গালিলিওর কাছে পরে এটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে মহাবিশ্ব শুধুমাত্র সৌরজগত নয় বরং আরও লক্ষাধিক তারা বাঁ নক্ষত্রের সমন্বয়ে গঠিত।
এর মানে এই না যে মহাবিশ্বকে অনেক বড় হতে হবে। এমনও হতে পারে যে সকল তারাগুলো সৌরজগতের বাইরে একটি নির্দিষ্ট স্থানে রয়েছে।
কিন্তু সৌরজগত কত বড়?
১৬৭১ সালে ইতালিয়ান ফ্রেঞ্চ জ্যোতির্বিদ জিওভানী ডি কাশি প্রথম গ্রহগুলোর অন্তর্বর্তী দূরত্ব নির্ণয়ে কাজ করেন। কাশির নির্ণীত দূরত্ব প্রায় সঠিক ছিল। পরে জ্যোতির্বিদগণ তা সামান্য ঠিক করেন। এখন আমরা জানি যে পৃথিবী সূর্য থেকে ৯,৩০,০০,০০০ মাইল দূরে অবস্থিত। কিছু গ্রহ সূর্য থেকে আরও অনেক বেশি দূরে অবস্থিত। শনি সূর্য থেকে প্রায় ৮০,০০,০০,০০০ মাইল দূরে অবস্থিত।
তাহলে মহাবিশ্ব কত বড়? প্লুটো পর্যন্ত চিন্তা করলে আমাদের সৌরজগত সাত বিলিয়ন ব্যাসের একটি গোলক।
কিছু জ্যোতির্বিদ অন্যরকম চিন্তা করতেন। তারা ধারণা করেছিলেন যে নক্ষত্রগুলো একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থান করছে এবং বেশি উজ্জ্বল নক্ষত্র হতে কম উজ্জ্বল নক্ষত্র দূরে অবস্থিত। যেমন আমরা সূর্য হতে অধিক উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখতে পাই না কারণ তারা সূর্য থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রটিও প্লুটো হতে অনেক অনেক দূরে অবস্থিত। কিন্তু নক্ষত্রগুলো কেন এত অনুজ্জ্বল অস্পষ্ট দেখায়? এটি দেখানোর বা প্রমাণ করার কি কোনও উপায় আছে? গ্রীক জ্যোতির্বিদ ১৩০ অব্দে মহাকাশে অবস্থিত যেকোনো দুটি বিন্দুর দূরত্ব নির্ণয়ের পদ্ধতি বের করেন। একে বলে ‘Parallax’।
প্যারালাক্স ব্যবহার করতে হলে একটি বস্তুকে দুটি ভিন্ন স্থানে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং তার অবস্থানের পরিবর্তনের ধাপগুলো নোট করতে হবে। এই ব্যাপারটি তুমি বুঝতে পার, নিজের মুখের সামনে নিজের হাতের একটি আঙ্গুল ধরে। প্রথমে মুখের সামনে আঙ্গুল রেখে ডান চোখ বন্ধ করে বাম চোখ দিয়ে দেখে আঙ্গুলের অবস্থান লক্ষ্য করতে হবে। তার পরে মুখ এবং আঙ্গুলের অবস্থান স্থির রেখে বাম চোখ বন্ধ করে ডান চোখ দিয়ে লক্ষ্য কর। এবার তুমি আঙ্গুলের অবস্থানের পরিবর্তন দেখতে পাবে।
এই অবস্থানের পরিবর্তনের পরিমাণ নির্ভর করে চোখ হতে তোমার আঙ্গুলের দূরত্বের উপর। যত দূরে থাকবে তত কম পরিবর্তিত হবে যা প্যারালাক্স। তোমার চোখ হতে অনেক দূরের কোনো বস্তুর কোনো পরিবর্তনই তুমি দেখতে পাও না।
যদি অনেক দূরের কোনো বস্তুর প্যারালাক্স তুমি দেখতে চাও তবে তোমাকে নির্দিষ্ট দূরত্বের দুটি ভিন্ন স্থান হতে তোমাকে একটি বস্তুকে দেখতে হবে।
যদি এটি গ্রহ বা তারার ক্ষেত্রে হয় তবে কয়েক মাইল দূরত্ব যথেষ্ট নয়। কিন্তু যদি কয়েক শত মাইল দূরত্বে হয় তবে? তখন তুমি অন্যান্য তারাদের সাপেক্ষে নির্দিষ্ট তারাটির একটি ক্ষুদ্র পরিবর্তন দেখতে পাবে। প্যারালাক্সের পরিমাণ, দুটি ভিন্ন স্থানের মধ্যবর্তী দূরত্ব হতে একটি গ্রহ বা একটি তারা বা একটি নক্ষত্রের দূরত্ব নির্ণয় করা যায়। সমস্যা হয় যখন কাছাকাছি অবস্থিত তারাগুলো অনেক দূরে অবস্থিত, তখন প্যারালাক্স অনেক ক্ষুদ্র হবে আর এরকম হলে গণনা করা কঠিন হয়।
জার্মান জ্যোতির্বিদ ফ্রেডরিক ডব্লিউ বেসেল ১৮৩৮ সালে ক্ষুদ্র প্যারালাক্স নির্ণয় করতে সক্ষম হন। যেখান থেকে সে নক্ষত্রটির দূরত্ব নির্ণয় করেন। এখান থেকে বোঝা যায় যে সবচেয়ে কাছের তারাটিও প্লুটোর থেকেও অনেক বেশি দূরে অবস্থিত। সবচেয়ে কাছের তারাটি হলো Proxima Centauri যা ২৫,০০০,০০০,০০০,০০০ মাইল দূরে অবস্থিত। এটিই সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র। এর থেকেও অনেক অনেক দূরে আরও অনেক নক্ষত্র আছে।
তারাগুলোর দূরত্ব পরস্পর থেকে হাজার বিলিয়ন মাইল দূরে অবস্থিত যা নিয়ে কথা বলা জটিল ব্যাপার। এতোগুলো শূন্য নিয়ে কাজ করা আসলেই অনেক জটিল ব্যাপার। জ্যোতির্বিদগণ এর সমাধান বের করেছিলেন আলোর সাহায্যে।
আলো সকল বস্তু থেকে দ্রুত গমন করতে পারে। আলো প্রতি সেকেন্ডে ১,৮৬,২৮২ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে। আলো চাঁদ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত আসতে সময় নেয় মাত্র ৫/৪ সেকেন্ড। আলো সূর্য হতে পৃথিবীতে আসতে সময় নেয় প্রায় আট মিনিট। এক্ষেত্রে আলোকে ৯৩,০০০,০০০ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়।
আলো ১ বছরে কত দূরত্ব অতিক্রম করে?
১ বছরে ৩১,৫৫৭,০০০ সেকেন্ড! তবে আলো ১ বছরে অতিক্রম করে ৫,৮৮০,০০০,০০০,০০০ মাইল। এটি প্রায় ছয় হাজার বিলিয়ন মাইল দূরত্ব। এই দূরত্বকে এক আলোক বর্ষ দূরত্ব বলে।
Proxima Centauri পৃথিবী থেকে ৪.৪ আলোক বর্ষ দূরে অবস্থিত। এর মানে হলো আমরা যখন Proxima Centauri কে দেখছি তখন আসলে ৪.৪ বছর আগের Proxima Centauri কে দেখছি!
দক্ষিণ আকাশের Sirius তারা ৮.৬৩ আলোকবর্ষ দূরে এবং Arcturus তারা ৪০ আলোক বর্ষ দূরে অবস্থিত।
Orion এর সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা Rigel ৫৪০ আলোক বর্ষ দূরে অবস্থিত!
১৮৫০ সালের দিকে এটি স্পষ্ট হয় যে মহাবিশ্ব অনেক বিশাল!
Feature Image Courtesy: news.softpedia.com
References: How did we know about Universe? Issac Asimove