মহাবিশ্ব কত বড় হতে পারে সে সম্পর্কে কি ধারণা করা সম্ভব? মহাবিশ্বের বিস্তৃতি কি উজ্জ্বল নক্ষত্র যাদের আমরা দেখতে পাই তাদের থেকেও অনেক অনেক দূরে? মহাবিশ্বের বিস্তৃতি কি অন্তহীন? এই ব্যাপারটা থেকেই ধারণা করা যায় যে মহাবিশ্ব আসলে ‘অসীম’ অর্থাৎ মহাবিশ্ব অনন্তকাল পর্যন্ত বিস্তৃত, এর কোনও অন্ত বা শেষ নেই।
কিছু জ্যোতির্বিদ মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কথা মাথায় রেখে মনে করতেন যে মহাবিশ্ব অনন্তকাল পর্যন্ত বিস্তৃত হয় অর্থাৎ এর সীমা আছে। মিল্কিওয়ে হলো এমন আলোক কুয়াশায় আচ্ছন্ন অঞ্চল যেখানে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে নক্ষত্রগুলি অবস্থান করছে।
মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির একপাশে আলোক কুয়াশা অনেক বেশি ঘন। এর থেকে বুঝা যায় যে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ঐ অংশে অনেক নক্ষত্র ঘন হয়ে অবস্থান করছে। আবার এর অন্যপাশে আলোক কুয়াশা অতোটা ঘন নয় অর্থাৎ হালকা। এর থেকে বুঝা যায় যে সেই অংশে নক্ষত্রের সংখ্যা কম। এখান থেকে ধারণা করা যায় যে নক্ষত্রগুলি যদি পরস্পরের খুব কাছাকাছি চলে আসে তবে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।
একজন জার্মান ইংরেজ জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম হার্সেল এই ব্যাপারটি নিয়ে ১৭৮৪ সালে কথা বলেছিলেন। তখনো তারাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব নির্ণয় করার পদ্ধতি আবিষ্কার হয়নি।
এই জ্যোতির্বিদ চিন্তা করেন যে তিনি আকাশের সমস্ত নক্ষত্রের সংখ্যা গণনা করে ফেলবেন। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন যে তারাদের সংখ্যা আকাশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম কি-না!
বাস্তবে আসলে টেলিস্কোপ দিয়ে দেখে দেখে নক্ষত্রদের সংখ্যা গণনা করে বের করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কারণ আকাশে নক্ষত্রের সংখ্যা হচ্ছে লক্ষাধিক। হার্সেল এর প্রতিকার বের করেছিলেন। তিনি পুরো আকাশকে ৬৮৩টি ছোট ছোট সমান অঞ্চলে বিভক্ত করেছিলেন।
তিনি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কাছে একটি ছোট জায়গা দেখতে পান যেখানে আরও নক্ষত্র আছে যাদের তিনি গণনা করতে পারেন। সেখানে খুব অল্প পরিমাণ নক্ষত্র ছিল যারা মিল্কিওয়ে থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখছিলেন।
মিল্কিওয়ের পাশে যে নক্ষত্রের সমাবেশ হয়েছিল তা-কি মিল্কিওয়ের প্রভাবে হয়েছিল?
হার্সেল এমনটা ভাবতেন না। তিনি মনে করতেন নক্ষত্রগুলো মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করছে। কোনও কোনও জায়গায় তারা অনেক বেশি দূরত্বে এবং কোথাও তারা কম দূরত্বে অবস্থান করছে।
অন্য কথায় আসলে হার্সেল মনে করতেন না যে নক্ষত্রগুলো গোলক বা গামলা আকৃতির মত করে অবস্থান করে না। অর্থাৎ নক্ষত্রগুলো মহাবিশ্বে অবস্থান করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
মনে করি যে নক্ষত্রগুলি নিজেদের মধ্যে একটি গোলকের আকৃতির মত করে অবস্থান করছে। তাহলে যদি আমি এই গোলকটির মধ্যবিন্দু বা কেন্দ্রে দাড়াই তবে আমি দেখতে পাব যে এর পরিধিতে নক্ষত্রগুলো অবস্থান করছে। এক্ষেত্রে মহাবিশ্বের সব নক্ষত্র কেন্দ্র থেকে সমদূরবর্তী হবে। আমরা সব সময় সমান সংখ্যক নক্ষত্র দেখতে পাব।
মনে করি নক্ষত্রগুলি একত্রে একটি সমতল হ্যাম বার্গারের মত করে অবস্থান করছে। আমরা যদি সেই হ্যাম বার্গারের কেন্দ্রে থাকি তবে? আমরা যদি বেশি বিস্তৃত পরিধির দিকে তাকাই তবে নক্ষত্রগুলিকে ভালোভাবে দেখতেই পাব না। কারণ তারা অনেক অনেক বেশি দূরত্বে অবস্থান করবে।
এখানে নক্ষত্রগুলো একটি আলোক কুয়াশার তৈরি করবে। এবার যদি এই আকারটা বৃত্তাকার হয় তবে আমরা আকাশের বিভিন্ন স্থানে এরকম আরও বৃত্ত দেখতে পাব। ঠিক যেমনটা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ক্ষেত্রে দেখতে পাই।
আমরা যদি এই বৃত্তাকার অংশে তাকাই তবে এর যে অংশ সমতলের মত অর্থাৎ চিকন হয়েছে সেই অংশে তারাদের পরিমাণ থাকবে অনেক অল্প অর্থাৎ সে অংশে তারাদের পরিমাণ কমতে থাকবে। এই সকল অংশে হয়তো নক্ষত্র থাকবে কিন্তু কোনও আলোক কুয়াশা থাকবে না।
যদি নক্ষত্রগুলো প্যাঁটির মত আকৃতি করে অবস্থান করে থাকে তবে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির আলোক ব্যান্ডগুলোর মাঝে নক্ষত্র অবস্থান করবে আরও আকীর্ণ ভাবে যেমনটা হার্সেল ভেবেছিলেন।
হার্সেল শেষ পর্যন্ত এই নক্ষত্রদের একত্রে হ্যাম বার্গারের প্যাঁটির আকৃতির মধ্যে অবস্থান করাকে একটি নাম দিন। এই নামটি হলও ‘গ্যালাক্সি’।
হার্সেল জানতেন না যে গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে কত দূরত্বে অবস্থান করছে। তিনি এও জানতেন না যে একটি গ্যালাক্সির মধ্যে এতগুলো নক্ষত্র থাকতে পারে। তিনি এও জানতেন না যে নক্ষত্রগুলো পরস্পর থেকে কতদূরে অবস্থান করে?
একদা দুটি নক্ষত্রের মধ্যেকার দূরত্ব নির্ণয় করতে মানুষ সক্ষম হন। তখন আবার মানুষ হার্সেলের সেইসব তত্ত্ব এবং চিত্রগুলি দেখতে থাকেন। এখান থেকে গ্যালাক্সি পার্শ্বে ১৫০০ আলোক বর্ষ দূরত্বে প্রস্থ এবং দৈর্ঘ্যে ৮০০০ আলোক বর্ষ দীর্ঘ। একটি গ্যালাক্সি সম্ভবত ৩০০,০০,০০টি নক্ষত্র ধারণা করতে পারে।
এটিই কি গ্যালাক্সির প্রকৃত আকৃতি? একটি গ্যালাক্সিই কি পুরো মহাবিশ্ব তৈরি করেছে? যদি হয় তবে গ্যালাক্সি অনেক বড় তবে এটি অসীম নয়।
পরবর্তীতে জ্যোতির্বিদগণ হার্সেলের ধারণাকে আরও সমৃদ্ধ করেন। তাদের কাছে আরও শক্তিশালী টেলিস্কোপ ছিল। তারা এই টেলিস্কোপ দিয়ে অনেক দূরের তারাগুলোকে দেখতে এবং তাদের ছবি তুলতে পারতেন। তারাদের দিকে তাকিয়ে তাদের বুঝতে পারার থেকে তারাদের ছবি দেখে তাদের বুঝতে পারা সহজ।
তারা বুঝতে পারল যে হার্সেলের নির্ণীত গ্যালাক্সির আকার ঠিক ছিল কিন্তু সাইজ ঠিক ছিল না। একজন ডাচ জ্যোতির্বিদ জ্যাকোবাস সি ক্যাপ্টিন ১৯২০ সালে বলেন গ্যালাক্সি অবশ্যই ৫৫,০০০ আলোকবর্ষ লম্বায় এবং ১১,০০ আলোক বর্ষ প্রস্থে বিস্তৃত হবে।
হার্সেল এবং ক্যাপ্টেন উভয়েই ভাবতেন যে আমাদের সৌরজগত গ্যালাক্সির কেন্দ্রের খুব কাছে অবস্থিত কেননা পৃথিবী থেকে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি সব দিকে সমান আলোকোজ্জ্বল দেখায়। কিন্তু এটি স্পষ্ট যে সৌরজগত গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত নয়। এটি ‘গ্লোবিউলার কাসটার্স’ যা হলও অনেকগুলো তারার মিলন স্থল গোল আকৃতিতে। হার্সেল নিজে তাদেরকে আবিষ্কার করেন। ১৮০০ সালে প্রায় ১০০ নক্ষত্রকে কাসটার্সে চিহ্নিত করা হয়।
এমন কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি যার জন্য গ্লোবিউলার কাসটার্স গ্যালাক্সির সবদিকেই বিস্তৃত থাকবে। আমাদের সৌরজগত যদি কেন্দ্রে থাকত তবে আমরা কাসটার্সকে চারদিকে সমভাবে দেখতে পেতাম!
কিন্তু আমরা দেখি না! একটি কাসটার্স পুরো আকাশের প্রায় অর্ধাংশ জুড়ে অবস্থান করে। এমনকি তাদের এক তৃতীয়াংশ Constellation of Sagitterius নিয়ে গঠিত যা আকাশের ২ শতাংশ অংশ দখল করে। এটি কেন এরকম রহস্যময় হিসেবেই থেকে যাবে?
একজন আমেরিকান জ্যোতির্বিদ সোয়ান লেভিট ১৯১২ সালে ‘সেফিড’ তারা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। এখানে এমন কিছু তারা ছিল তারা নিয়মিত উজ্জ্বল ও অনুজ্জ্বল হয়। সেফিড একটি নির্দিষ্ট সময়ে উজ্জ্বল এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে অনুজ্জ্বল হয়।
এইসময় আরও লক্ষ করা যায় যে এই তারাটির উজ্জ্বল কালের স্থায়িত্ব অনেক বেশি। আর গ্যালাক্সিগুলো এতো দূরে ছিল যে প্যারালাক্স ব্যবহার করে তাদের দূরত্ব নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব ছিল।
মনে কর একজন জ্যোতির্বিদ লক্ষ করলেন যে দুটি সেফোয়েড একই সময়ে উজ্জ্বল অবস্থায় আছে। এর মানে হলও সে দুটি সেফোয়েডের প্রত্যেকের থেকে সমান দূরত্বে আছেন কেননা তিনি তাদের সমান উজ্জ্বল দেখছেন। আবার যদি এমন হয় যে কোনও একটি সেফোয়েড দেখতে অন্যটি হতে বেশি উজ্জ্বল তবে অবশ্যই উজ্জ্বল তম নক্ষত্রটি তার কাছাকাছি অবস্থিত।
এখান থেকে তাদের দূরত্ব নির্ণয় করা সহজ ছিল না। জ্যোতির্বিদের অবশ্য অনেক জটিল হিসেব নিকেশ করতে হয়েছে। অবশেষে তারা সক্ষম হলেন সেফোয়েড দিয়ে বিশাল বিশাল দূরত্ব নির্ণয় করতে।
একজন আমেরিকান জ্যোতির্বিদ হার্লে শাপলে এককভাবে এটি করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। সে কাছে থেকে কাসটার্স নিয়ে গবেষণা করেন এবং একপাশে একটি সেফোয়েড দেখতে পান। তিনি এই সেফোয়েডকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং এর পর্যায়, উজ্জ্বলতার সময়কাল এবং অন্যান্য ব্যাপারগুলো লিপিবদ্ধ করেন। এর থেকে তিনি কাসটার্সের দূরত্ব নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েও যান।
গ্লোবিউলার কাসটার্স পৃথিবী থেকে দশ হাজার আলোক বর্ষ দূরত্বে অবস্থিত। শাপলে মনে করেন যে গ্লোবিউলাস কাসটার্সের কেন্দ্রই হলো আসলে গ্যালাক্সির কেন্দ্র বিন্দু! এখান থেকে আরও বোঝা যায় যে সৌরজগত আসলে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে বাঁ কেন্দ্রের কাছাকাছি কোথাও নেই। সৌরজগত আসলে গ্যালাক্সির পরিধির কোনও এক অংশে রয়েছে।
তবে এই ক্ষেত্রে কেন মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি সব দিকে সমান উজ্জ্বল দেখায়?
এর কারণ আসলে নক্ষত্রগুলোর তৈরি গ্যাস আর ধুল কণার জন্যে এমন টা দেখা যায়। যখন টেলিস্কোপ আবিষ্কার হয় তখন এইসব দেখা যায়।
সুইচ আমেরিকান জ্যোতির্বিদ রবার্ট জে ট্রাম্পলার দেখাতে সক্ষম হন যে গ্যালাক্সি আসলে দৈর্ঘ্যে ১০০,০০০ আলোক বর্ষ এবং প্রস্থে ১৬,০০০ আলোক বর্ষ প্রস্থ। আমাদের সৌরজগত গ্যালাক্সির কেন্দ্র হতে ৩০,০০০ আলোক বর্ষ দূরে এবং শেষ প্রান্ত হতে ২০,০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। গ্যালাক্সি মাত্র ৩,০০০ আলোকবর্ষ পুরু।
আমাদের গ্যালাক্সি সম্ভবত ৩০০,০০০,০০০,০০০ টি নক্ষত্র বহন করছে। এদের মধ্যে ৮০ ভাগ আমাদের সূর্য থেকে আকারে ছোট। যদি তারা আমাদের সূর্যের সমান বড় হত তবে নক্ষত্রের সংখ্যা হতো ১০০,০০০,০০০,০০ টি!
Feature Image Courtesy: Nasa
Reference: How did we know about Universe? Issac Ashimove