হার্সেলের আবিষ্কৃত গ্যালাক্সির আকার নিয়ে কাজ করার প্রায় দেড়শ বছর পর জ্যোতির্বিদরা ভেবেছিলেন যে সকল গ্যালাক্সি অবশ্যই ছিল। গ্যালাক্সি কত বড় তা নিয়ে তর্ক যা-ই থাকুক না কেন গ্যালাক্সি আসলে পুরো মহাবিশ্ব জুড়েই বিস্তৃত। অন্ততপক্ষে আসলে দেখে তাই মনে হয়। জ্যোতির্বিদগণ টেলিস্কোপের মাধ্যমে এমন কিছু দেখেন নি যাতে বুঝা যায় ব্যাপারগুলো গ্যালাক্সির বাইরে মিথ্যা।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরিচিতি: গ্যালাক্সিদের কথা (দ্বিতীয় পর্ব)
একটি ব্যাপারে আশা ছিল। দক্ষিণ আকাশের দিকে তাকালে দুটি আলোক কুয়াশা দেখা যায়। এদের দেখে মনে হয় এরা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির দুটি আলাদা খন্ড যারা দূরে চলে গিয়েছে কোনোভাবে। এদেরকে বলা হয় ‘ম্যাগালানিক ক্লাউড’। এই নামকরণ করা হয় পর্তুগিজ পরিব্রাজক ফার্দিনান্ড ম্যাগালান এর নাম অনুসারে।
ম্যাগালিন যখন তার জাহাজ বহর নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণ করছিলেন তখন তার দলই প্রথম ইউরোপিয়ান হিসেবে ম্যাগালানিক ক্লাউড দেখেছিলেন। তারা যখন দক্ষিণ আমেরিকায় ছিলেন তখন তারা ম্যাগালানিক ক্লাউড দেখেছিলেন। কিন্তু তারা উত্তরে ইউরোপ থেকে এই দুটি ম্যাগালানিক ক্লাউড দেখতে পান না।

জ্যোতির্বিদরা যখন টেলিস্কোপ দিয়ে ম্যাগালানিক ক্লাউড দেখতেন তখন আসলে তারা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মত অনেক গুলো নক্ষত্রের মিলন মেলা দেখতে পান। এই নক্ষত্রগুলোর মধ্যে কিছু ছিল সেফোয়েড। এমন কি লেভিট যে সেফোয়েড গুলো আবিষ্কার করেছিলেন এবং যা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন তা ম্যাগালানিক ক্লাউডে অবস্থান করছিল।
সেফোয়েড গুলোর পর্যায়কাল হিসেব করে দেখান যে দুটি ম্যাগালানিক ক্লাউডের মধ্যে বড়টি আমাদের থেকে ১৫৫,০০০ আলোকবর্ষ দূরে এবং ছোট টি ১৬৫,০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।

এই ক্লাউডগুলো আসলে আমাদের গ্যালাক্সির বাইরে ছিল। এরা প্রত্যেকে আসলে এক একটি গ্যালাক্সি যারা আমাদের গ্যালাক্সির থেকে ছোট। বড় গ্যালাক্সিটি ১০,০০০,০০০,০০ (দশ বিলিয়ন) নক্ষত্র এবং ছোট গ্যালাক্সিটি ২,০০০,০০০,০০০ (২ বিলিয়ন) নক্ষত্র ধারণ করছে। উভয় গ্যালাক্সি মিলে আমাদের গ্যালাক্সির মাত্র বারো ভাগের এক ভাগ নক্ষত্র ধারণ করে। এমনও হতে পারে যে আমাদের গ্যালাক্সি আসলে পুরো বিশ্ব জুড়ে আছে এবং স্যাটেলাইট গ্যালাক্সিদ্বয় তার মাত্র একটি সামান্য অংশ।
জার্মান জ্যোতির্বিদ সিমন মরিস ১৬১২ সালে কাউন্টেশনাল এন্ড্রোমিডায় একটি মৃদু আলোর টুকরোকে বর্ণনা করেন। এটি একটি ‘নেব্যুলা’ ছিল। এর অবস্থানের জন্য একে ‘এন্ড্রোমিডা নেব্যুলা’ বলে।

বেশিরভাগ জ্যোতির্বিদগণ মনে করেছিলেন এটি একটি গ্যাস ও ধূলিকণার সংমিশ্রণ। কিছু নেব্যুলা থেকে আলো নিঃসরিত হতো কারণ কিছু কিছু ক্লাউডের মাঝে নক্ষত্র ছিল। কিছু কিছু জ্যোতির্বিদ মনে করতেন যে এন্ড্রোমিডা নেব্যুলা ধূলিকণা ও গ্যাসের একটি মিশ্রণ ছিল। এর থেকে আলো নিঃসরিত হতো কারণ এটি তার গ্র্যাভিটির মাধ্যমে নক্ষত্র থেকে আলো নিঃসরণ করতো।
ফরাসী জ্যোতির্বিদ পিয়েরে দ্য ল্যাপলাস ১৭৯৯ সালে বলেন যে আমাদের সৌরজগত নিজে সোয়ার্লিং গ্যাস তৈরি করে। এই তত্ত্বকে বলে ‘নেব্যুলা হাইপোথিসিস’।

অন্যান্য নেব্যুলাতে যে নক্ষত্র আছে তারা নেব্যুলাটি যা দিয়ে তৈরি তাদের আলোকিত করে। এইসকল নেব্যুলা থেকে আলো নির্গত হয় বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের। এন্ড্রোমিডা নেব্যুলা হতে যে তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো নির্গত হয় তার সাথে নক্ষত্রগুলোর থেকে নির্গত আলোক তরঙ্গ এর সম্ভাব্য মিল পাওয়া যায়।
এন্ড্রোমিডা নক্ষত্র হতে যে আলো নির্গত হয় তা আসলে নক্ষত্র দ্বারা আলোকিত ধূলিকণার মত ছিল না। দেখে মনে হয় যে সরাসরি এই নেব্যুলা থেকেই আলো নির্গত হচ্ছে। এই ক্লাউড টি কি অনেকগুলো নক্ষত্রের দ্বারা গঠিত গ্যালাক্সিদের মতো?
সমস্যা হচ্ছে ক্লাউড টির মাঝে কোনো নক্ষত্র খুঁজে পাওয়া যায় নি। ক্লাউড টি শুধু সাদা আলোর একটি আধার মাত্র।
সেক এমন কিছু একটা ছিল যা তারাদের সাময়িকভাবে আলোকিত করে। মাঝে মাঝে নক্ষত্র গুলো অস্বাভাবিক রকম ভাবে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং পরে তারা আবার তাদের পূর্বের উজ্জ্বলতায় ফিরে যায়। এই নক্ষত্রগুলো উজ্জ্বলতার সময় দৃশ্যমান হয় এবং আবার যখন পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায় তখন অদৃশ্য হয়ে যায়। টেলিস্কোপ আবিষ্কারের পূর্বে এইসব তারাগুলোকে ‘নোকেলি স্টেলা’ বলা হত। বর্তমানে এদেরকে ‘নোভাস’ বলে সম্বোধন করা হয়।

এন্ড্রোমিডা নেব্যুলার সাথে কি নেব্যুলার কোনও কানেকশন আছে? নাকি নক্ষত্রগুলো এমনভাবেই মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রকটিত হয়ে নেব্যুলাকে আলোকিত করে থাকে?
আমেরিকান জ্যোতির্বিদ হেবার ডি কার্টিস ১৯০০ সালে এই সমস্যাটি নিয়ে কাজ করেন। যদি নেভাস এমনিতেই নেব্যুলার সামনে প্রকটিত হয় তবে তাদেরকে একইভাবে অন্যান্য দিকেও প্রকটিত হওয়া উচিত। অন্তত কিছু দিকে তো অবশ্যই!
কিন্তু এমন টি হয় না। একটি বড় সংখ্যক নোভাস এন্ড্রোমিডা নেব্যুলার সামনে প্রকটিত হয়। কিন্তু বর্তমানে মহাবিশ্বের সামান্য কিছু অংশেও এদের প্রকটিত হতে দেখা যায়। এই হুট করে প্রকটিত হবার ব্যাপার টি মোটেও স্বাভাবিক ছিল না।
আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে নোভাস নেব্যুলার ভিতরে অনেক অনুজ্জ্বল ছিল। এমন কি হতে পারে যে এন্ড্রোমিডা নেব্যুলা অনেক অনেক দূরে অবস্থান করছিল বলে তারা অনুজ্জ্বল ছিল? এরকম হলে অবশ্যই এন্ড্রোমিডা নেব্যুলা তে নক্ষত্রের অবস্থান আছে কিন্তু কোনো নক্ষত্র খুঁজে পাওয়া যায় নি।
১৮৮৫ সালে হুট করেই একটি নক্ষত্র এন্ড্রোমেড নেব্যুলাতে প্রকটিত হয়। এই নক্ষত্রটি অন্য যেকোনো নোভাসের থেকে বেশি উজ্জ্বল ছিল। এটি এতোটাই উজ্জ্বল ছিল যে টেলিস্কোপ ছাড়াও একে প্রায় দেখা যেত। এটি কি নেব্যুলার একটি অংশ হতে পারে?
আরো দেখা যায় যে মহাবিশ্বের অন্যান্য অংশেও এমন নোভাস দেখা যায় যারা সাধারণ নোভাসের থেকে বেশি উজ্জ্বল। এরকম আরেকটি নক্ষত্র ১৫৭২ সালে দেখা যায় যা শুক্র গ্রহের থেকেও বেশি উজ্জ্বল ছিল। উজ্জ্বল হয়ে আবার হুট করেই অনুজ্জ্বল হয়ে যায়! এর ফলে সুইস জ্যোতির্বিদ ফ্রিটজ জুইকি নোভাসের এই উজ্জ্বলতা কে ‘সুপারনোভা’ নামকরণ করেন।

সুপারনোভা খুব অল্প সময়ের জন্য হতে পারে। তবে এটি সাধারণ নক্ষত্রের থেকে ১০০,০০০,০০০,০০০ গুণ বেশি উজ্জ্বল হতে পারে। এমন কি হতে পারে যে এন্ড্রোমিডা নেব্যুলাতে অল্প সময়ের জন্য সুপারনোভা হয়েছিল এবং তাই দেখা গিয়েছিল। ঠিক এটিই ঘটেছিল!
১৫৭২ সালের সুপারনোভা কি শুক্রের থেকেও বেশি উজ্জ্বল ছিল? ১৫৭২ সালের ঘটা সুপারনোভা আমাদের খুব কাছে হয়েছিল যেখানে ১৮৮৫ সালে এন্ড্রোমিডা নেব্যুলাতে ঘটা সুপারনোভা ছিল অনেক দূরে।
এরপর অনেক অনেক বছর পর্যন্ত এই বিতর্ক ছিল যে সুপারনোভা কি আমাদের গ্যালাক্সির ভিতরে ঘটেছিল নাকি বাইরে ঘটেছিল!
১৯১৭ সালে ক্যালিফোর্নিয়াতে একটি নতুন টেলিস্কোপের ব্যবহার শুরু হয়। এটি এর পূর্বে আবিষ্কৃত সকল টেলিস্কোপের থেকে ভালো ছিল। এই টেলিস্কোপ ব্যবহার করে আমেরিকান জ্যোতির্বিদ এডউইন পি হাবল এন্ড্রোমিডা নেব্যুলার ছবি তুলতে সক্ষম হন এবং দেখতে পান যে সেখানে অনেক অনেক নক্ষত্র রয়েছে! কার্টিসের বক্তব্য সঠিক ছিল। এন্ড্রোমেডা আমাদের থেকে অনেক অনেক দূরে অবস্থান করছিল।
এটি আসলেই একটি গ্যালাক্সি ছিল যা আমাদের থেকেও আকারে বিশাল ছিল। এরপর থেকে এর নামকরণ করা হলও ‘এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি’।

অনেক হিসেব নিকেশের পরে দেখা যায় যে এই গ্যালাক্সিটি আসলে ২,৩০০,০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এটি ম্যাগালানিক ক্লাউডের থেকে ১৫ গুণ বেশি দূরে অবস্থিত। এটি আমাদের গ্যালাক্সির থেকে প্রায় দ্বিগুণ নক্ষত্র ধারণ করেন। এর পরে আরও অনেক গ্যালাক্সি সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি। দুই ডজন গ্যালাক্সির একটি গ্রুপকে ‘লোকাল গ্রুপ’ বলে।

১৯৬৩ সালে জ্যোতির্বিদগণ কোয়াসার আবিষ্কার করেন। সবচেয়ে দূরবর্তী কোয়াসার ১০,০০০,০০০,০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।
সম্ভবত মহাবিশ্বে ১০০,০০০,০০০,০০০ টি গ্যালাক্সি এবং মহাবিশ্ব প্রায় ২৫,০০০,০০০,০০০ আলোকবর্ষ জুড়ে বিস্তৃত।
Feature Image Courtesy: Nasa
Reference: How did we know about Universe? Issac Ashimove