আচ্ছা, এই মহাবিশ্ব কি সব সময় এমনি ছিল? অনন্ত কাল পর্যন্ত কি এভাবেই থাকবে? এরকম প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে আলোর বর্তমান কিছু আবিষ্কারের পিছনে।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরিচিতি: গ্যালাক্সিদের কথা (তৃতীয় পর্ব) পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আলোকরশ্মি যখন প্রিজমের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে তখন আলো ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্য থেকে বৃহৎ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোক রশ্মিতে বিভক্ত হয়। আমরা এ থেকে বুঝতে পারি যে আলোকরশ্মি মূলত অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর সংমিশ্রণ। এখানে বৃহৎ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মৌলিক আলোকরশ্মি আর ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মি ভিন্ন প্রান্তে অবস্থান করে। একে বলা হয় ‘স্পেকট্রাম’।

ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্য আমাদের চোখে ভিন্ন ভিন্ন রঙে সনাক্ত হয়। লাল আলো সবচেয়ে উচ্চ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের এরপর কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল এবং সবশেষে সর্বনিম্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মি হলো বেগুনী।
কিছু তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো সূর্যের আলোকরশ্মিতেও পাওয়া যায় না। স্পেকট্রামেও তাদের কোনো আলো পাওয়া যায় না। যার ফলে সেইসব অংশ অন্ধকারাছন্ন থাকে। সূর্য রশ্মির আলোতে এরকম হাজারো কালো লাইন পাওয়া যায়।

স্পেকট্রা অন্য আলোর উৎস থেকেও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেখান থেকে সূর্যের আলো ও অন্য আলোক উৎসের মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে তাদের মধ্যেকার কালো লাইন বা ‘স্পেকট্রাম লাইন’ এর মধ্যে পার্থক্য পাওয়া যায়।
যখন সূর্যরশ্মি হতে আলোকরশ্মি আমাদের কাছে আসে তখন তার খুব কম অংশই আমাদের কাছে পৌছায়। স্পেকট্রাম লাইন তখন বেগুনী স্পেকট্রামের শেষে থেকে শুরু হয়। এজন্য একে ‘বেগুনী শিফট’ বলে অভিহিত করা হয়। স্পেকট্রাম লাইন লাল বা অবলোহিত অঞ্চলেও শিফট হয়। একে বলা হয় ‘অবলোহিত শিফট’।

এই রেখাগুলোর শিফটকে বলা হয় ‘ডপলার ফিজিও ইফেক্ট’। একজন অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান ডপলার ১৮৪২ সালে এটি প্রথম ব্যাখ্যা করেন। সে সাউন্ডের কানেকশন নিয়ে কাজ করতেন। তার অল্পকিছু পরেই ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানী আর্মন্ড এইচ এল ফিজিও দেখান যে এটি আলোর ক্ষেত্রেও কাজ করে।
এটি আমাদের নক্ষত্র সম্পর্কে কিছু ধারণা দেয়। নক্ষত্রদের আলো স্পেকট্রামের মধ্যে দিয়ে কালো লাইনের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। জ্যোতির্বিদগণ আলাদা আলাদা স্পেকট্রাম লাইন সম্পর্কে শিখতে শুরু করেন।

এই আলোর শিফট যদি বেগুনির দিকে হয় তবে নক্ষত্রটি কাছে আসে আবার লালের দিকে হলে নক্ষত্র দূরে সরে যায়। তাই এই শিফটের সত্যিকারের পরিমাণ করতে পারলে এই কাছে আসা ও দূরে যাওয়ার পরিমাণ আমরা নির্ণয় করতে পারব। কত বেগে কীভাবে এই পরিবর্তন হচ্ছে তাও নির্ণয় করতে পারতাম।
ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম হাইগিংস ১৮৬৮ সালে অবশেষে সিরিয়াস নক্ষত্রের স্পেকট্রাম বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হন। তিনি দেখতে পান যে এই অন্ধকার রেখার পরিবর্তন হচ্ছিল লালের দিকে। অর্থাৎ এই নক্ষত্রটি আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আর এই দূরে সরে যাওয়ার হার হচ্ছে ৫ মাইল পার সেকেন্ড।
এর পরে অনেক জ্যোতির্বিদ আরও অনেক নক্ষত্রের স্পেক্ট্রা বিশ্লেষণ করেছেন। তারা দেখেছেন যে কিছু নক্ষত্র আমাদের থেকে কীভাবে সরে যাচ্ছে বা আমাদের দিকে আসছে। তারা দেখতে পান কিছু তারা আমাদের দিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে এবং এটি দেখে তারা মোটেই অবাক হন নি! তাদের এই দূরে সরে যাওয়া বা এগিয়ে আসার হার ৫ মাইল পার সেকেন্ড থেকে ৭০ মাইল পার সেকেন্ড এর মধ্যে অবস্থিত।

একজন আমেরিকান জ্যোতির্বিদ ভেস্তো এম স্লিফার ১৯১২ সালে এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি থেকে স্পেকট্রাম নিতে সক্ষম হন। তখন অবশ্য এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি হিসেবে পরিচিত ছিল না। এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি আমাদের দিকে ১২০ মাইল পার সেকেন্ড বেগে আসছিল। এই চলনের হার অন্য সকল নক্ষত্র থেকে অনেক বেশি ছিল। এটি দেখে স্লিফার মোটেই বিচলিত হলেন না। তিনি অন্যান্য নেব্যুলা থেকে স্পেকট্রাম নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করেন অন্ধকার রেখা নিয়ে। ১৯১৭ সালে তিনি প্রায় ১৫টি স্পেকট্রাম নিয়ে কাজ করেন।
এই সময়টাতে তার কাছে দুটি সমস্যা ছিল। একটি তিনি ধরে নিবেন যে অর্ধেক নক্ষত্র দূরে সরে যাচ্ছে আর অর্ধেক নক্ষত্র কাছে আসছে। কিন্তু বাস্তবে এমনটি ছিল না। তার ঐ ১৫টির মধ্যে মাত্র দুইটি আমাদের দিকে আসছিল বাকিরা দূরে সরে যাচ্ছিল!
দ্বিতীয় সমস্যাটি ছিল এই সরে যাওয়ার হার নিয়ে। ১৩টি নক্ষত্র সরে যাওয়ার গড় হার ছিল প্রায় ৪০০ মাইল পার সেকেন্ড। যা অন্যান্য সাধারণ নক্ষত্রের হারের তুলনায় অনেক বেশি।
স্লিফার আরো অনেক সরে যাচ্ছে এমন তারার হার নির্ণয় করলেন এবং দেখলেন যে এই দূরে সরে যাওয়ার হার ক্রমশ বাড়ছেই। যখন হাবল দেখালেন যে তারা আসলে গ্যালাক্সি। তখন জ্যোতির্বিদগণ ভাবতে শুরু করলেন যে কেন এই গ্যালাক্সিগুলো এতো দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে? যেখানে অন্যান্য তারা গুলো এতো ধীরে ধীরে যাচ্ছে।

এর পর আরেকজন জ্যোতির্বিদ মিল্টন এল হামসন আরও দূরবর্তী গ্যালাক্সির স্পেকট্রাম নিয়ে কাজ করতে থাকেন। সে বিভিন্ন ভাবে এইসব গ্যালাক্সির ছবি তুলতে শুরু করেন যাতে করে এদের নিয়ে আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। তিনি ১৯২৮ সালে এমন একটি গ্যালাক্সির সন্ধান পান যা ২৪০০ মাইল পার সেকেন্ড বেগে দূরে সরে যাচ্ছিল। তিনি ১৯৩৬ সালে এমন একটি গ্যালাক্সির স্পেকট্রাম আবিষ্কার করেন যা ২৫,০০০ মাইল পার সেকেন্ড বেগে দূরে সরে যাচ্ছিল। এতো বেশি অবশ্যই অনেক আশ্চর্যজনক ছিল। এদের কীভাবে বর্ণনা করা যায়?
হাবল এই ব্যাপারে অনেক আগ্রহী ছিলেন। তিনি বের করতে শুরু করেন এই গ্যালাক্সিগুলো আসলে কত দূরে ছিল। সে যত দূরের স্পেকট্রাম নিয়ে গবেষণা হয়েছে তার থেকেও দূরবর্তী গ্যালাক্সির স্পেকট্রাম সংগ্রহ ও তাদের নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন।
তিনি যখন এগুলো করে ফেললেন তখন তিনি কিছু অস্বাভাবিকতা দেখতে পেলেন। দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলো বেশি দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছিল। এমন কি এই দূরে সরে যাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধির হারও ছিল ধ্রুবক। একে ‘হাবলের সূত্র’ বলে। এটি ১৯২৯ সালে আবিষ্কৃত হয়।

কিন্তু গ্যালাক্সিরা কেন আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? গ্যালাক্সিগুলো নিজেদের মধ্যে কেন এতো দ্রুত এতো বেশি দূরত্ব তৈরি করছিলো? এসকল প্রশ্নের উত্তর তখন সকল জ্যোতির্বিদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।
এর উত্তর আমরা পেয়েছিলাম জার্মান বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের কাজের পরে। তিনি ১৯১৫ সালে মহাবিশ্ব সংক্রান্ত ‘থিওরি অফ রিলেটিভিটি’ তত্ত্বটি বর্ণনা করেন। এখানে তিনি ‘ফিল্ড ইকুয়েশন’ সম্পর্কে বলেন। এখানে মহাবিশ্বের প্রকৃতি কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।
আইনস্টাইন মনে করেছিলেন যে মহাবিশ্ব অবশ্যই ‘স্থিত’ হবে অর্থাৎ সময়ের সাথে সাথে এর পরিবর্তন হবে না। সে তার এই ফিল্ড ইকুয়েশনে নতুন এই স্থিত মহাবিশ্বকে তুলে ধরেন।

ডাচ জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম ডি সিটার ১৯১৭ সালে এই ফিল্ড ইকুয়েশন দেখান। এই মহাবিশ্ব ধ্রুব হারে সম্প্রসারিত হচ্ছে। সিটার এটি করেছিলেন মহাবিশ্বের সকল নক্ষত্রকে ‘নাই’ ধরে। রাশিয়ান গণিতবিদ আলেকজান্ডার ফ্রিম্যান ১৯২২ সালে দেখান যে ফিল্ড ইকুয়েশন মানে হলও আসলে একটি সম্প্রসারিত মহাবিশ্ব।

একজন ইংরেজ জ্যোতির্বিদ আর্থার এস ইডিংটন ১৯৩০ সালে দেখান যে যদিও আইনস্টাইনের স্থিতি মহাবিশ্ব থাকে তবে তা কখনও স্থিতি অবস্থায় থাকবে না। হয় এটি সম্প্রসারিত হবে না হয় এটি সংকুচিত হবে অথবা অনন্তকাল পর্যন্ত চলতেই থাকবে।আইনস্টাইনের ফিল্ড ইকুয়েশন আসলে হাবলের সূত্রকে বর্ণনা করেছিল ভালোভাবে।
Feature Image Courtesy: Live Science
Reference: How did we know about this Universe?