আচ্ছা, ‘দ্য সাইলেন্স অফ ল্যাম্বস’ সিনেমায় ড. হানিবাল লেকটার চরিত্রটি দেখে আপনার কি কখনো ভাবতে ইচ্ছে হয়নি যে তার মতো নরখাদক সিরিয়াল কিলারের অস্তিত্ব বাস্তব জীবনেও আছে কিনা? কিংবা কখনো ভেবে দেখেছেন যে ‘রাতসাসান’ সিনেমার ক্রিস্টোফার চরিত্রটির মতো বাস্তবেও প্রতিশোধপরায়ণ সিরিয়াল কিলার থাকতে পারে কি? অথবা কখনো মনে প্রশ্ন জাগেনি যে ‘সেভেন’ সিনেমার জন ডো চরিত্রের মতো বা ‘সাইকো’ সিনেমার নর্মান বেটস চরিত্রের মতো উদ্ভট মানসিকতার সিরিয়াল কিলার কি বাস্তবেও দেখা যেতে পারে?
বাস্তবের সিরিয়াল কিলাররা আরো ভয়ংকর ও তাদের কাজকর্ম আরো বীভৎস। এমন তিনজন বাস্তব সিরিয়াল কিলারের কীর্তিকলাপ নিয়েই আজকের আয়োজন, যা সিনেমার কাহিনীকেও হার মানায়।
জ্যাক দ্য রিপার
জ্যাক দ্য রিপার সিরিয়াল কিলারের আবির্ভাব হয় ১৮৮৮ সালে। তার আসল পরিচয় এখনো শনাক্ত করা যায়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে জ্যাক দ্য রিপার একজন ভালো সার্জন ছিলেন এবং তার মানবদেহ নিয়ে অগাধ জ্ঞান ছিল। তাকে জ্যাক দ্য রিপারের পাশাপাশি ‘হোয়াইটচ্যাপেলের খুনি’ ও ‘লেদার অ্যাপ্রোন’ নামেও ডাকা হতো।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে ব্রিটেনে অভিবাসী অনুপ্রবেশ নিয়ে কোনো কঠোর আইন না থাকায় আইরিশরা ও পূর্ব ইউরোপ থেকে ইহুদীরা ব্রিটেনে অবাধে অনুপ্রবেশ করতো। অনুপ্রবেশকারীদের একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল নিম্ন আয়ের মানুষ। সে সময়ে মেয়েদের কাজের অভাব থাকায় শুধু হোয়াইটচ্যাপেলেই ৬২টি পতিতালয় ছিল এবং পতিতার সংখ্যা ছিল ১২০০ এর বেশি। এর দ্বারা বোঝাই যাচ্ছে তখনকার ব্রিটেনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা ছিল ভয়াবহ।
১৮৮৮ সালের ৩১ শে আগস্ট মেরি অ্যান নিকোলস নামক একজন পতিতার মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল হোয়াইটচ্যাপেলের রাস্তায়। মেরিকে খুবই বীভৎসভাবে খুন করা হয়েছিল। তার গলা শরীর থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল এবং তলপেটের নিচের দিকের একটা অংশ খুনি নিয়ে গিয়েছিল। তার এক সপ্তাহ পরে ৮ সেপ্টেম্বরে এ্যানি চাপম্যানের মৃতদেহ পাওয়া যায়। তার মৃতদেহের অবস্থা প্রায় মেরির মতোই ছিল এবং এ্যানিও পতিতা ছিলেন। এ্যানির পেট পুরোপুরি ফাড়া হয়েছিল এবং খুনি তার যোনি ও জরায়ু কেটে নিয়ে গিয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, এ্যানির কাছে বাদামি রঙের হ্যাট ও ওভারকোট পরা উশকো-খুশকো চুলের এক ভদ্রলোক এসেছিল আর এর আধঘণ্টা পরেই এ্যানির নিথর দেহ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়।

জ্যাক দ্য রিপারের প্রতীকী চিত্র; Image Courtesy: smithsonianmag.com
এরপর ৩০ সেপ্টেম্বর ভোরে এ্যালিজাবেথ স্ট্রাইড ও ক্যাথারিন এডোসের লাশ দু’টি ভিন্ন জায়গায় পাওয়া যায়। খুনি ক্যাথারিনের শরীরের জরায়ু ও বাম কিডনির সিংহভাগ কেটে নিয়ে গিয়েছিল। তবে এ্যালিজাবেথের প্রধান ধমনী ও শ্বাসনালী কেটে ফেলা ছাড়া শরীরে আর কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না। হয়তোবা সেসময় খুনি ধরা পড়ার ভয়ে তাড়াহুড়ো করে পালিয়ে গিয়েছিল।
৯ নভেম্বরে মেরি জেন কেলির মৃতদেহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন অবস্থায় তার নিজ ঘরে পাওয়া যায়। তার মুখটা এমনভাবে বিকৃত করে দেওয়া হয়েছিল যার ফলে মৃতদেহ দেখে সহজে শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ মৃতদেহের আশেপাশে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছিল এবং খুনি হৃদপিণ্ডটি নিয়ে গিয়েছিল।
হোয়াইটচ্যাপেলে এই পাঁচটি খুনের পাশাপাশি সে সময়ে আরো ছয়টি খুন হয়। তবে এই ছয়টি খুন যে জ্যাক দ্য রিপারই করেছে তা নিশ্চিতভাবে বলা দুষ্কর। কারণ ঐ পাঁচটি খুনের ধরণের সাথে এই ছয়টি খুনের ধরণে বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। তবে ঐ পাঁচটি খুন জ্যাক দ্য রিপার নিজে করেছেন তা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে বলা যায় এবং তার এই পাঁচ খুনকে একত্রে ‘ক্যানোনিকাল ফাইভ’ বলা হয়।
ধারণা করা হয়, ১৮৯১ সালের পর এই খুনি হয়তো অন্যত্র চলে যায় বা মারা যায়। কারণ এরপরে এই ধরনের মৃতদেহ আর পাওয়া যায় নি। জ্যাক দ্য রিপার সন্দেহে ২০০০ মানুষকে জেরা করা হয়, ৮০ জনকে গ্রেফতার করা হয় ও তাকে ধরার জন্য ৩০০ লোককে নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়। এসবের পরে পুলিশের কাছে অনেক উড়োচিঠি আসতে থাকে ‘জ্যাক দ্য রিপার’ নামে। সেই থেকে এই খুনিকে জ্যাক দ্য রিপার নামে অভিহিত করা হয়।
জেফরি ডাহমার
সিরিয়াল কিলার, সমকামি, ক্যানিবাল ও নেক্রোফিলিয়াক জেফরি ডাহমারের অপরাধের সূচনা হয় ১৯৭৮ সালে। তিনি ‘মিলওয়াকি ক্যানিবাল’ ও ‘মিলওয়াকি মনস্টার’ নামেও পরিচিত। ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তিনি ১৭ জনকে হত্যা করেছেন। তিনি তার প্রত্যেক ভিকটিমকে মদের সাথে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে অচেতন করে ধর্ষণের পর তাদেরকে শ্বাসরোধে হত্যা করতেন। আবার কখনো কখনো মৃতদেহের সাথে জঘন্য যৌন মিলনেও লিপ্ত হতেন।

জেফরির মায়ের মানসিক সমস্যা থাকার কারণে তার শৈশব খুব একটা আনন্দময় ছিল না। অন্যদিকে তার বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। যার ফলে জেফরি একাকীত্বকে সঙ্গী করেই বেড়ে উঠছিলেন। শৈশব থেকেই জেফরির মৃত জীবজন্তুর প্রতি আকর্ষণ ছিল। চার বছর বয়সে তিনি তার বাবাকে পশুর হাড় সরাতে দেখেন। এটি দেখে জেফরি রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন এবং তখন থেকেই তার মৃতদেহের প্রতি আগ্রহ জন্মে।
কৈশোরে তিনি মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েন এবং নিজেকে সমকামী হিসেবে উপলব্ধি করেন। তার উদ্ভট যৌনকাঙ্ক্ষা ছিল; সঙ্গমের সময় সঙ্গীর উপর কর্তৃত্ব প্রদর্শনের প্রবল ইচ্ছে ছিল। ১৬ বছর বয়সে রাস্তায় পড়ে থাকা অজ্ঞান ব্যক্তির সাথে সঙ্গমের মাধ্যমে তিনি প্রথমবার এই ইচ্ছা পূরণের সুযোগ পান। তবে লোকটির জ্ঞান ফিরে আসলে ঝামেলা করতে পারে বিধায় জেফরি তাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং এটিই তার প্রথম হত্যার পরিকল্পনা ছিল, যদিও তা বাস্তবায়িত হয় নি।
১৯৭৮ সালে মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদের পর জেফরি বাসায় একাই থাকতেন এবং তিনি এই একা থাকার সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করেন। ১৯৭৮ এর ১৮ জুন স্টিভেন মার্ক হিকস নামক এক কিশোরকে বাসায় এনে তার সাথে অনেকক্ষণ মদ্যপান ও গান শোনায় মশগুল থাকার পর তাকে ডাম্বেল দিয়ে মাথায় আঘাত করেন জেফরি এবং তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। এরপর জেফরি মৃতদেহের সাথে বিকৃত যৌন মিলনে লিপ্ত হোন। পরে মৃতদেহটি কেটে বাসার পেছনে কবর দেন; সপ্তাহখানেক পরে দেহটি কবর থেকে তুলে দেহটির হাড় থেকে মাংস ছাড়ান। তারপর মাংস এসিডের দ্রবণে দ্রবীভূত করে টয়লেটে ফ্ল্যাশ করে দেন এবং হাড় গুলো হাতুড়ি দিয়ে চূর্ণ করে বাসার পেছনে ছড়িয়ে দেন। আর এভাবেই বীভৎসভাবে জেফরি তার প্রথম খুন করেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড্রপআউট হবার পর জেফরি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন মেডিকেল স্পেশালিস্ট হিসেবে। তবে সেখানে সৈন্যদেরকে যৌন নির্যাতন ও অতিরিক্ত মদ্যপানের অভ্যাসের কারণে তাকে বরখাস্ত করা হয়।

১৯৮১ সালের শেষার্ধে জেফরি তার দাদির সাথে বাস করা শুরু করলে তার জীবন পূর্বের তুলনায় অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। চকোলেট ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরুর পর ওয়েস্ট অ্যালিস লাইব্রেরিতে এক অচেনা ব্যক্তি তাকে অনৈতিক প্রস্তাব করে কিন্তু জেফরি এই প্রস্তাবে রাজি হননি। তবে এই ঘটনার পর তার মনে আবার পুরনো ইচ্ছাটি জেগে উঠে। তারপর থেকেই নিয়মিত বাথ হাউজে (গোসলখানা) তার যাওয়া-আসা শুরু হয়। যৌন মিলনের সময় সঙ্গীর নড়া-চড়া অসহনীয় লাগতো জেফরির। যার কারণে তিনি তার সঙ্গীদের মদের সাথে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়ে অচেতন দেহের সাথে যৌন মিলনে লিপ্ত হতেন। কারণ তিনি মূলত তাদের কখনোই মানুষ হিসেবে গণ্য করেন নি বরং তাদের আনন্দ আহরণের বস্তু হিসেবে বিবেচনা করতেন। বাথ হাউজে এভাবে ১২ জনের সাথে মিলিত হবার পর কর্তৃপক্ষ তার বাথ হাউজের সদস্যপদটি বাতিল করে দেয়।
জেফরি ১৯৮৭ সালে স্টিভেন টুয়োমিকে হোটেলে মূলত তার সাথে সঙ্গমের জন্যই এনেছিলেন। জেফরির তাকে মেরে ফেলার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। তবে পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি টুয়োমির নিথর দেহ দেখে তিনি পুরো বোকা বনে গিয়েছিলেন। কারণ টুয়োমির বুকে ছিল আঘাতের দাগ, মুখ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল এবং তার নিজের হাত ও কনুইয়েও আঘাতের দাগ ছিল। অর্থ্যাৎ তিনি নেশার ঘোরে কখন যে নিজের অজান্তেই টুয়োমিকে খুন করে ফেলেছেন তা তিনি বিন্দুমাত্র টের পান নি। এরপর তিনি মৃতদেহটি স্যুটকেসে ভরে বাড়িতে নিয়ে যান। সপ্তাহখানেক পর পূর্বের মতোই হাড় থেকে মাংস আলাদা করে ও দেহের অঙ্গগুলো আলাদা করে কেটে প্লাস্টিক ব্যাগে সেগুলো ভরে ফেলে দেন ও হাড় গুলোকে চূর্ণ করে বাড়ির পেছনে ছড়িয়ে দেন। আর মাথার খুলিটি নিজের কাছে রেখে দেন।
টুয়োমিকে অনিচ্ছাকৃতভাবে খুনের পর তার খুনের ইচ্ছাটা যেন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এরপর তিনি একের পর এক বীভৎস হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকেন এবং তার খুনের খড়্গ ১৪ বছরের কিশোরও এড়িয়ে যেতে পারেনি। তাদের তিনি ছবি তোলার লোভ কিংবা টাকার লোভ দেখিয়ে আনতেন। মৃতদেহের পরিণতি প্রায় পূর্বের দুই মৃতদেহের মতোই হয়েছিল।
মৃতদেহগুলোর অংশ বাড়ির বেসমেন্টে ফেলে দেওয়া হতো যার কারণে সেখান থেকে বিশ্রী গন্ধ ছড়াতো। আবার গভীর রাতে বাড়িতে অল্পবয়স্ক তরুণদের যাতায়াতও লক্ষণীয় ছিল। এসবের কারণে তার দাদির মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়; এজন্য তিনি জেফরিকে অন্যত্র চলে যেতে বলেন। ১৯৯০ সালে জেফরি একা একটি ফ্ল্যাটে বাস করা শুরু করলে তার অপরাধের স্পৃহা যেন আরো বেড়ে যায়।

১৯৯২ সালের একটি সাক্ষাৎকারে জেফরি ডাহমার; Image Courtesy: insideedition.com
অ্যান্থনি সিয়ার্স নামক এক সুদর্শন মডেলকে তার এতোই ভালো লেগেছিল যে তিনি অ্যান্থনিকে খুনের পর তার মাথা ও যৌনাঙ্গ আলাদা করে লকারে রেখে দিয়েছিলেন ও পরে সেগুলোর মমি বানিয়ে রেখেছিলেন। তিনি তার ষষ্ঠ খুন থেকে মৃতদেহের বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তুলে তা নিজের কাছে রেখে দেওয়া শুরু করেন। জেফরি অনেক সময় খুনের পর ফ্রিজে মৃতদেহের মাংস, হৃদপিণ্ড ও অন্যান্য অংশ রাখতেন খাওয়ার জন্য। এছাড়াও মৃতদেহ টুকরো করে বিশাল ড্রামে রেখে দিতেন।
প্রতিবেশীরা কয়েকবার তার বাসা থেকে বিশ্রী গন্ধ ও মাঝে মাঝে করাতের শব্দ পাওয়া যায় বলে অভিযোগ করেছিলো। কিন্তু বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে প্রতিবারই তিনি রক্ষা পেয়ে যান। জেফরি ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরকে বাসায় এনে আগের মতোই অজ্ঞান করে তার খুলি ছিদ্র করে সেখানে হাইড্রোক্লোরিক এসিড ঢেলে দিয়েছিলেন। মূলত তিনি ছেলেটিকে জোম্বি (জীবন্ত লাশ) বানানোর একটা এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন। এরপর জেফরি বাইরে যান; বাসার কাছে এসে তিনি যা দেখেছিলেন তার জন্যে তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি দেখেন ছেলেটি নগ্ন হয়ে ফুটপাতে বসে নারীদের সাথে গল্প করছে এবং এসিডের প্রভাবে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গিয়েছে। ঘটনাস্থলে পুলিশ এসে পড়লে জেফরি বলেন যে তার সাথে ছেলেটির প্রেমের সম্পর্ক আছে এবং প্রমাণ হিসেবে তিনি পুলিশকে তাদের অর্ধনগ্ন রোমান্টিক ছবি গুলো দেখান। ফলে তিনি এই যাত্রাতেও পার পেয়ে যান।
এভাবে সময় পার হতে থাকবে আর জেফরি আজীবন তার কুকীর্তি চালিয়েই যাবে, তা তো হতে পারে না। কারণ পৃথিবীতে কোনো কিছুই স্থায়ী নয় আর জেফরির জীবনও এর ব্যতিক্রম নয়। ১৯৯১ সালের ২২শে জুলাই এডয়ার্ডস ট্রেসি ১০০ ডলারের প্রস্তাবে জেফরির সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটাতে এসেছিলেন কিন্তু ট্রেসি ঘরে ঢোকা মাত্রই বিশ্রী গন্ধ তার নাকে এসে লাগে। এরপর প্রায় হঠাৎ করেই জেফরি ট্রেসির হাতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে দেন এবং তাকে বেডরুমে যেতে বলেন। যাওয়ার পর ট্রেসি দেখতে পান যে টিভিতে ‘দ্য এ্যাক্সরসিস্ট ৩’ সিনেমাটি চলছে (এই সিনেমাটি জেফরি ১৯৯০ সাল থেকে প্রতি খুনের আগে দেখতেন), তিনি দেখেন ঘরের কোণায় ৫৭ গ্যালনের একটি নীল ড্রাম আছে ও সেখান থেকেই বিশ্রী গন্ধটি আসছিল। এমন সময় জেফরি তাকে ছুরি দেখিয়ে তার হৃদপিন্ড খেয়ে ফেলার হুমকি দেয়। এমন ভয়ংকর অবস্থাতেও ট্রেসি মাথা ঠাণ্ডা রেখেছিলেন। তারপর তিনি টয়লেটে গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় সেখান থেকে পালিয়ে যাবার একটি পরিকল্পনা করেন। যখনই জেফরি একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলেন ঠিক তখন ট্রেসি তাকে সজোরে একটি ঘুষি মেরে দরজা খুলে দৌড়ে পালিয়ে যান। রাস্তায় গিয়েই দুজন পুলিশকে ট্রেসি দেখতে পান এবং তাদের সব খুলে বলেন। তারপর পুলিশ জেফরির ফ্ল্যাটে গিয়ে তল্লাশি চালায় এবং জেফরিকে গ্রেফতার করা হয়। জেফরির পুরো ফ্ল্যাট তল্লাশি করে দু’টো কঙ্কাল, এক জোড়া কাটা হাত, দু’টো যৌনাঙ্গ, মাথার চামড়ার মমি, তিনটি হাত-পা-মাথাবিহীন দেহ, সাতটি মাথার খুলি, দুটো হৃদপিণ্ড, ফ্রিজে মানুষের দেহের বিভিন্ন অংশের মাংসসহ ৭৪ টি ছবি পাওয়া যায় যেখানে ভুক্তভোগীদের দুরাবস্থা ফুটে উঠেছিল। জেফরির ছবিগুলো তোলার পিছে মূল কারণ ছিল ভুক্তভোগীদের শারীরিক সৌন্দর্য ও তদের উপস্থিতি স্মরণীয় করে রাখা।

জেফরি তার সকল দোষ শিকার করে নিয়েছিলেন এবং প্রত্যেকটি খুনের রোমহর্ষক ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছিলেন। যেহেতু টুয়োমিকে খুনের ঘটনা তার স্মৃতিতে ছিল না তাই ১৬টি হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিল। যার ফলে তাকে ১৬ বার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় অর্থ্যাৎ ৯৪১ বছরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
তবে তিনি বেশিদিন এই শাস্তি ভোগ করতে পারেননি। কারণ ১৯৯৪ সালের ২৮শে নভেম্বর কারেকশনাল ইন্সটিটিউটে থাকাবস্থায় ক্রিস্টোফার স্কার্ভার নামক আরেক আসামী ২০ ইঞ্চি লম্বা ধাতব দণ্ড দিয়ে তাকে পিটিয়ে হত্যা করেন। আর এভাবেই অন্যতম কুখ্যাত সিরিয়াল কিলারের জীবনাবসান ঘটে।
টেড বান্ডি
থিওডোর রবার্ট বান্ডি বা টেড বান্ডিকে প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন সিরিয়াল কিলার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ তার আইকিউ ছিল ১৩৬ যা সারা বিশ্বের মধ্যে মাত্র ২% মানুষের থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তার মধ্যে আদর্শ আইনজীবী, রাজনীতিবিদ- সর্বোপরি একটি দেশ চালানোর মতো যোগ্যতা ছিল। তিনি যেমন জ্ঞানী ছিলেন তেমন সুদর্শন ছিলেন; যার কারণে তিনি খুনের দায়ে গ্রেফতার হওয়ার পরেও তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে মেয়েদের অসংখ্য চিঠি আসতো।

টেড বান্ডি, Image Courtesy: seattletimes.com
তবে টেড বান্ডি ঠিক কবে থেকে খুন করা শুরু করেছিলেন তা তিনি একেক জনকে একেক তথ্য দিয়েছিলেন। টেডের মতে, তিনি ১৯৬৯ সাল থেকে অপহরণ করা শুরু করেছেন এবং ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত অগণিত মেয়েকে খুন করেছেন। সিরিয়াল কিলার হবার পাশাপাশি তিনি একাধারে ধর্ষক ও নেক্রোফিলিয়াক ছিলেন। তিনি একজন প্রতিশোধপরায়ণ সিরিয়াল কিলার ছিলেন কারণ তার ভিকটিমেরা প্রায় সকলেই দেখতে তার প্রথম প্রেমিকা ডিয়েন এডওয়ার্ডসের মতো ফর্সা ও মাঝখানে সিঁথি করা ঘন চুলের অধিকারী ছিলেন এবং তারা প্রায় সকলেই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী। মূলত ডিয়েন টেডকে ছেড়ে যাবার পর তিনি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন এবং তার মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা জাগ্রত হয়।
১৯৭৪ সালে তিনি লিন্ডা এ্যান হিলি নামক এক মেয়ের ঘরে দরজা ভেঙ্গে ঢুকে তাকে আঘাত করে অজ্ঞান করেন এবং বিছানার চাদর দিয়ে মুড়িয়ে তাকে নিয়ে পালিয়ে যান। এরপর থেকে প্রায় প্রতি মাসে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী নিখোঁজ হতে থাকে। তিনি তার প্রত্যেক ভিকটিমকেই একই কৌশলে শিকার করতেন। টেড হাতে প্লাস্টার নিয়ে বা ক্রাচে ভর দিয়ে অসুস্থ মানুষ হবার ভান করতেন আর চলাফেরার জন্যে ভক্সওয়াগন বিটল গাড়িটি ব্যবহার করতেন। তারপর সু্যোগ বুঝে পছন্দমত কোনো তরুণীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে ভাঙা হাত দিয়ে মালপত্র গাড়িতে তোলার চেষ্টা করতেন। এতে অনেকে দয়াপরবশ হয়ে টেডকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতেন আর তখনই টেড সাহায্যকারীকে তার ভিকটিমে পরিণত করতেন।

তিনি সাধারণত তার ভিকটিমদের ধর্ষণ করতেন এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন; এরপর তাদেরকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করতেন। মাঝে মাঝে মৃতদেহের সাথে যৌন মিলনে লিপ্ত হতেন। অনেক সময় কারো কারো মাথা কেটে রেখে দিতেন; আবার কখনো কখনো মৃতদেহের সাথে ঘুমাতেনও। মূলত তিনি যৌন উন্মত্ততার সাথে তার ভিকটিমদের খুন করেছিলেন। তার ভিকটিমদের মধ্যে একজন অপহরণের পর গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল এবং পরবর্তী সময়ে সেই মেয়েটিই টেডকে ধরতে সহায়তা করে।
১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট তিনি প্রথমবার পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানোর সময় পুলিশ তার পিছনে ধাওয়া করছিল, পরে একসময় থামতে বাধ্য হন তিনি। পুলিশ তার গাড়ি তল্লাশি করে গ্লাভস, হ্যান্ডকাফ, স্কি মাস্ক, দড়ি, টর্চলাইট, স্ক্রু ডাইভারসহ আরো কিছু জিনিস পান। পরে বাড়ি তল্লাশি করে সন্দেহজনক কিছু না পাওয়ায় তাকে সাধারণ চোর-ডাকাত মনে করে ছেড়ে দেওয়া হয়।

তবে এরপর থেকেই তিনি পুলিশ-গোয়েন্দাদের কড়া নজরদারিতে ছিলেন কারণ প্রাণে বেঁচে যাওয়া সেই ভিকটিমটি অপরাধীর গাড়ির সম্পর্কে যা বর্ণনা দিয়েছিলেন তা টেডের গাড়ির সাথে মিলে যাচ্ছিল। যার ফলে তাকে খুন ও অপহরণের কাজে জড়িত ব্যক্তি হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছিল। এরপরে ১৯৭৬ সালে ১ মার্চ টেডকে সেই মেয়েটিকে অপহরণের অভিযোগে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এরপরে টেড এমন সব নাটকীয় কর্মকাণ্ড করেন যার পরিণতি ভয়াবহ ছিল।
১৯৭৭ সালে টেডকে অ্যাসপেনের জেলে স্থানান্তরিত করা হয় এবং তিনি নিজের কেসে লড়ার জন্য কোনো উকিল নেননি। নিজের কেস নিয়ে লেখাপড়ার জন্য তাকে জেলের লাইব্রেরিতে হ্যান্ডকাফ ছাড়াই যেতে দেওয়া হতো আর এই সুযোগটিই তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন। তিনি বুকশেলফের পেছনের জানালা দিয়ে দোতলা থেকে লাফ দিয়েছিলেন। তারপর অ্যাসপেন পর্বতে গিয়ে ছয় দিন আত্মগোপনে ছিলেন। তারপর শহরে যাবার চেষ্টা করলেই তিনি ধরা পড়েন।

প্রথমবার পালানোর পরিকল্পনা বিফলে গেলে তিনি পুনরায় জেল থেকে পালানোর পথ খোঁজা শুরু করেন। টেড কোনো এক কয়েদি থেকে হ্যাকসো ব্লেড জোগাড় করেছিলেন। একদিন অন্য কয়েদিরা গোসলে ব্যস্ত থাকার সময় তিনি তার সেলে একটি গর্ত দেখতে পান। তারপর থেকে নিয়মিত সেই গর্ত খনন করা শুরু করেন। পালানোর সুবিধার্থে নিজের ১৬ কেজি ওজন কমান তিনি। এরপর ডিসেম্বরের শেষে বড়দিনের উৎসবের আমেজের সু্যোগের সদ্ব্যবহার করেন টেড। কারণ সে সময় কয়েদিরা তাদের পরিবারের সাথে দেখা করতে ব্যস্ত ছিল এবং চিফ জেলার তার স্ত্রীকে নিয়ে কোথাও গিয়েছিলেন। সিলিং ভেঙে তিনি সেই জেলারের রুমে ঢুকেই নিজের বেশভূষা পরিবর্তন করে জেল থেকে পালিয়ে যান। ১৭ ঘণ্টা পর টেডের পালিয়ে যাবার ব্যাপারটি সবার চোখে পড়ে। আর ততক্ষণে টেড মুক্তির স্বাদ নিতে শিকাগোতে চলে গিয়েছিলেন।
শিকাগো থেকে মিশিগান, আটলান্টা হয়ে শেষে তিনি ফ্লোরিডাতে আসেন এবং সেখানে তিনি ছদ্মনামে একটি হোটেলের রুম ভাড়া করেন। হোটেলটি ছিল ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ও তিনি প্রায়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে ঘোরাফেরা করতেন। তিনি একটি ভক্সওয়াগেন গাড়িও চুরি করেছিলেন। ফ্লোরিডাতেও তার নৃশংস হত্যাকাণ্ড থেমে থাকেনি বরং সেখানে একজন ১২ বছর বয়সের শিশু সহ মোট তিনি তিনটি খুন করেন। এর মধ্যে দুইটি খুন তিনি একই দিনে করেন। তাদেরকে মারাত্মক যৌন নির্যাতনের পর কুপিয়ে ও শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছিল।
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৮ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি পুলিশ রাস্তায় টহল দেওয়ার সময় চুরি করা ভক্সওয়াগেন গাড়িটি দেখতে পান। তারপর তারা টেডকে অনুসরণ করেন। টেডও এই ব্যাপারটি টের পেয়ে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে পালনোর চেষ্টা করেন। তবে পুলিশের গাড়ি তাকে ঘিরে ধরলে তিনি পালাতে ব্যর্থ হন।

টেডের হাতে নিহত ভিকটিমেরা; Image Courtesy: inews.co.uk
গ্রেফতারের পরের কাজগুলো খুব দ্রুততার সাথে ঘটতে থাকে। টেডের বিরুদ্ধে যেসব খুন, খুনের চেষ্টা ও ধর্ষনের অভিযোগ আসতে লাগলো সেগুলো একের পর এক প্রমাণিত হতে থাকে। এর পাশাপাশি জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে বিভিন্ন খুনের রোমহর্ষক বর্ণনাও বেরিয়ে আসতে লাগলো।
মনে করা হয়ে থাকে যে টেড ১০০ এর অধিক খুন করেছেন এবং এর মধ্যে ৩০টি আদালতে প্রমাণ করা গিয়েছে। কারণ বেশিরভাগেরই মৃতদেহ পাওয়া যায় নি। ১৯৮৯ সালের ২৪শে জানুয়ারি ইলেক্ট্রিক চেয়ারে বসিয়ে ২০০০ ভোল্ট ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে টেডের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মৃত্যুর পূর্বে তার শেষ কথা ছিল, “I’d like to give my love to my family and friends.”
ইতিহাসের প্রতিটি সিরিয়াল কিলারকে অনেকটাই তার জীবনের পটভূমি এসব কাজ করতে প্রভাবিত করেছে এবং তাদের শেষ পরিণতিও তাদের কর্মকাণ্ডের মতোই ভয়াবহ। এরা প্রত্যেকেই তাদের নিজ এলাকার মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত আতঙ্ক ছড়িয়েছে। তাদের জঘন্য কাজের কারণে মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার ভয় ছিল দীর্ঘ সময় ধরে। তাই বিশ্বে অপরাধের পরিমাণ কমাতে হলে প্রত্যেক মানুষকেই তার নিজের মানসিক অবস্থা নিয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। একই সাথে অপরাধের পরিণাম নিয়ে একবার হলেও সবার ভেবে দেখা উচিত।
Feature Image Courtesy: theweek.inReferences:
References:
- britannica.com
- বাংলাদেশ প্রতিদিন
- roar.media
- oxygen.com
- crimemuseum.org
- onlinepsychologydegree.com
- youtube.com
- Mirror.co.uk