পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটি সোমালিয়া। বর্তমানে এখানকার তরুণরা স্বপ্ন দেখা ভুলে গেছে। তাদের স্বপ্নগুলো বোমার আঘাতে শীতের বিষণ্ণতায় আবৃত। এখানকার শিশুদের হাসিতে ঝর্না ঝরে না। তারা জীর্নশীর্ন দেহেও বাঁচার আকুতি নিয়ে চলে। মৃত্যুদেবতা যেন এখানে খুব ব্যস্ত, দম ফেলার ফুরসতও নেই। মানুষগুলো না খেতে পেলেও শকুনের খাদ্য ঠিকই জুটছে। তবে কী মৃত্যু দেবতাও আজ ক্লান্ত?
সোমালিয়ার সোনালী অতীত
সোমালিয়ার সোনালী অতীত শুনলে যে কারো চোখ চড়কগাছ হবে। প্রায় ৯,০০০ খ্রিষ্টপূর্বে এখানে বসতি গড়ে উঠে। এদের ভাষা মূলত আরবি। আর অধিকাংশ মানুষই মুসলমান। ৬,০০,০০০ বর্গকিলোমিটারের এই দেশের প্রায় অনেকটা জুড়েই বিশাল মরুভূমি। এছাড়া তৃণভূমি ও মালভূমিও রয়েছে। যদিও উত্তরে পুরোটা সুবিশাল সমুদ্র। কেনিয়া ও ইথিওপিয়া এর বড় প্রতিবেশী রাষ্ট্র। মাত্র এক কোটি মানুষের বাস এখানে। এক সময় যা বেশ কিছু গোত্রে বিভক্ত ছিল, বেশ কিছু বিখ্যাত সালতানাত ছিল। এর মধ্যে অন্যতম হলো, আদেল সালতানাত, ওয়ারসাংগালি সালতানাত। সালতানাতগুলো অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতো। একসময় বাণিজ্যে তাদের খ্যাতি সুদূর ইউরোপ, মধ্যেপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পরে। আর উত্তর দিকে পুরোটা সমুদ্র হওয়ায় ঐতিহ্যবাহী শহর মোগাদিসু হয়ে উঠে বাণিজ্যর প্রাণকেন্দ্র। এখনো ইতিহাস আর ঐতিহ্যের ছাপ লেগে আছে মোগাদিসুর প্রতিটা ধুলিকণায়। দেওয়ালগুলো সাক্ষী দেয় সোনালী অতীতের।

স্বাধীনতা পরবর্তী সোমালিয়া
মধ্যযুগ থেকে সালতানাতগুলো বিভক্ত ও দুর্বল হতে থাকে। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ, অবিশ্বাস, প্রতারণা, ক্ষমতার লোভ ও ইউরোপের আধুনিক সভ্যতা থেকে পিছিয়ে পরাই ছিল এর স্বাধীনতা হারানোর কারণ। একের পর এক রাষ্ট্র ইউরোপের দাসত্বে পরিণত হয়। সোমালিয়ার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। দীর্ঘদিন এর বড় অংশ ইটালির অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর এক অংশ ব্রিটিশদের দখলে ছিল। কিন্তু ১৯৪১ সালে ইতালি পরাভূত হয় এবং পুরো সোমালিয়া ব্রিটিশদের দখলে চলে যায়। এ সময় থেকেই দেশটিতে আধুনিকতার ছোয়া লাগে।
পৃথিবীব্যাপী একে একে ব্রিটিশরা তাদের আধিপত্য হারাতে থাকে। তরুণরা স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬০ সালে পুরো সোমালিয়া একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। দেশটিতে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রথম প্রধাণমন্ত্রী হন আদম আব্দুল্লাহ উসমান। তিনি প্রায় সাতবছর ক্ষমতায় থাকেন এবং ইতালি ও যুক্তরাজ্য শাসিত অঞ্চলকে একত্রিত করে আধুনিকতায় ভরা রাষ্ট্রের সূচনা করেন। সে সময় সোমালিয়াকে বলা হতো আফ্রিকার সুইজারল্যান্ড। আফ্রিকার সবচেয়ে নিরাপদ শহর ছিল মোগাদিসু। ক্রমেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয় এটি। বিদেশীদের উপস্থিতিতে সবসময় গমগম করত সোমালিয়ার শহর। শিক্ষার হার দ্রুত বাড়তে থাকে, চিকিৎসা সেবাও যে কোন দেশের হিংসা লাগার মতো পর্যায়ে চলে যায়। সাত বছর ক্ষমতায় থাকেন তিনি। এরপর অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন হন আবদিহ রশিদ আলী শারমা।

দেশটির দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট আলী শারমাকে তারই দেহরক্ষী খুন করলে অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা দেখা দেয়। ক্ষমতা নেন স্পিকার মুখতার মোহাম্মদ হোসেন। কিন্তু মাত্র ছয়দিনের মাথায় তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন জেনারেল সিয়াদ বারে। থেমে যায় গণতন্ত্রের অব্যাহত যাত্রা। ১৯৮০ সাল পযর্ন্ত দীর্ঘ অপশাসন চলে। তার শাসন আমলেই দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পরে এবং ছিন্নবিছিন্ন হয়ে যায় এ সুন্দর সমাজ। ১৯৯৫ সালে দেশটির আরেক স্বৈরশাসক মুহাম্মাদ আব্দুল বারের মৃত্যুর পর পরিস্থিতি মারাত্মক ঘোলাটে হয়। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পরে তীব্র গৃহযুদ্ধ যার ফলাফল লক্ষ লক্ষ শরণার্থী। ওদিকে অস্থিরতার সুযোগে ১৯৯১ সালে দেশটির উত্তর অঞ্চল নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে। উদ্ভব হয় সোমালিল্যান্ড নামক রাষ্ট্রের। অন্যদিকে ১৯৯৮ সালে স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল পুটল্যান্ড নিজেদের স্বশাসিত বলে ঘোষণা দেয়। বতর্মান এভাবেই অস্থিরতা নিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে দেশটি।

কুখ্যাত জলদস্যুতার দেশ
সোমালিয়ার সমুদ্র সীমানাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদজনক নৌরুট বলা হয়। শুনলে অবাক হবেন, দেশটির বতর্মান অর্থনীতির একটা বিরাট অংশই আসে অপহরণের পর আদায় করা মুক্তিপণ থেকে। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, কীভাবে এত সাধারণ ও সহজ সরল মানুষগুলো হিংস্রতা নিয়ে সমুদ্রের বিশাল জাহাজ আটক করা শিখলো।
একটু পেছনে ফিরি, ৯০ এর দশক তখন। যুদ্ধ আর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বিধ্বস্ত সবাই। লক্ষ লক্ষ মানুষ পাশের দেশ কেনিয়ায় শরণার্থী হচ্ছে। ঠিক তখনি উন্মুক্ত হয়ে পরে দেশের বিশাল জলরাশি। টহল দেওয়ার মত কেউ ছিল না। সুযোগ নেয় মানবতার বুলি আওড়ানো ইউরোপ। বিশাল বিশাল ড্রামে করে তারা হাসপাতালের বর্জ্য, তেজষ্কিয় পদার্থ খালাস করতে থাকে সোমালিয়ার উপকূলে। মারাত্মক বিষাক্ত ওই পদার্থে ছেয়ে যায় দেশটির সমুদ্র উপকূল। ধারণা করা হয় তারা টাকা দিয়ে ইতালির অন্ধকার জগতের মাফিয়াদের দ্বারা এগুলা খালাস করায়। ২০০৪ সালের সুনামির পর হাজার হাজার বর্জ্য ভর্তি ড্রাম ভেসে আসে। তেজষ্কিয়তার প্রভাবে জটিল ও বিরল রোগে আক্রান্ত হয় উপকূলের জনগণ। একের পর এক বিকলাঙ্ক সন্তান জন্ম হতে থাকে।
ইউরোপের এ নিয়ে না ছিল কোন উচ্চবাচ্য, না ছিল কোন রুপ ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রবণতা। অন্যদিকে তারা আধুনিক জাহাজে করে চুরি করে নিয়ে যেতে থাকে দেশটির বিশাল মৎস সম্পদের ভান্ডার। স্থানীয় সাধারণ জেলেরা এটি প্রতিরোধের অনেক চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ হয় তখন অস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করে এবং সফল হয়। এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতোই একদিকে জলপথ সংরক্ষিত হয় অন্যদিকে বন্ধ হয় তেজস্ক্রিয় পদার্থে ভরা ড্রাম খালাস করা। অন্যদিকে দ্রুত ধনী হওয়ার পথ পেয়ে যায় সমুদ্র তীরবর্তী তরুণরা। বর্তমানে দেশটির জিডিপির বড় অংশ আসে জলদস্যুতা করে অর্জিত অর্থের মাধ্যমে।

আল শাবাব জঙ্গিগোষ্ঠী: সোমালিয়ার ক্যান্সার
কট্টর ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা থেকেই আল শাবাব এর জন্ম। একদিকে গৃহযুদ্ধ অন্যদিকে অর্থনৈতিক অস্থিরতা এই দুইয়ের সুযোগে হঠাৎ তৈরি এই সংগঠন একসময় সোমালিয়ার বৃহৎ অংশ দখল করে নিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আফ্রিকান ইউনিয়ন ও কেনিয়ার যৌথ আক্রমণে মোগাদিসু ছেড়ে পিছু হটলেও রাজধানীর বুকে রেখে যায় ক্ষতচিহ্ন। অত্যন্ত নৃশংস এই সংগঠনটি জনপূর্ণ বাজার বা সেনাবাহিনীর উপর আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে প্রায়ই খবরের কাগজে জায়গা করে নেয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পযর্ন্ত হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ তাদের হামলায় নিহত হয়। মূলত বিভিন্ন দরিদ্র এলাকা থেকে তারা সদস্য সংগ্রহ করে থাকে। শরণার্থী শিবির হলো তাদের সদস্য সংগ্রহের মূল টার্গেট। কেনিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বিচারে শিক্ষার্থী হত্যা ছিল তাদের বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের মধ্যে অন্যতম।

দু’মুঠো ভাত জোগাড় করতে না পারা সোমালীয়রা আজও ঘুমানোর সময় সোনালী অতীতের কথা স্মরণ করে স্বপ্ন দেখে। লাশের মিছিলের যাত্রা বন্ধ হবে, পৃথিবীর সংবাদপত্রের প্রথম পেজগুলো ভরে যাবে না কোনো সোমালিয়ের কঙ্কালসার ছবিতে কিংবা রুগ্ন শিশুর শকুনের খাবার হওয়ার যাত্রাপালার ছবিতে। বরং তরুণরা হবে শিক্ষিত আর সোমালিয়রা হবে শ্রেষ্ঠ জাতি এ আশা নিয়েই তারা শুরু করে প্রতিটি দিন।
Feature Image Courtesy: hrw.org