বিংশ বা একবিংশ শতাব্দীর কোনো ব্যক্তিকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় আপনার সবচেয়ে প্রিয় কার্টুনের নাম কী? তাহলে বেশিরভাগেরই উত্তর হবে টম এ্যান্ড জেরি। প্রথম পছন্দ হিসেবে না থাকলেও অন্তত প্রথম তিন পছন্দের কার্টুনের মধ্যে একটি হবে এই টম এ্যান্ড জেরি। গত ৮০ বছরে শিশু-বুড়ো সকলের মনেই জায়গা করে নিয়েছে এই কার্টুন।
উইলিয়াম হ্যানা ও জোসেফ বারবারার অনন্য সৃষ্টি এই টম এ্যান্ড জেরিতে নীলাভ ধূসর রঙের একটি বিড়াল ও বাদামি রঙের ইঁদুরের বৈরী তবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে হাস্যরসাত্মকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আর এই ইঁদুর-বিড়ালের ঝগড়া, মারামারি এবং একজনের আরেকজনের প্রতি ভালোবাসা দর্শকের মনে এগুলোর গভীরভাবে ছাপ পড়েছে বলেই কার্টুনটির আট দশক পেরোলেও এর জনপ্রিয়তায় এতোটুকু ভাটা পড়ে নি।
কার্টুনটির জন্মের ইতিহাস
১৯৩০ সালে এম.জি.এম (মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ার) অ্যানিম্যাশন স্টুডিওতে আমেরিকান অ্যানিমেটর রুডলফ আইজিঙের ইউনিটের হয়ে কাজ করতেন গল্পলেখক ও চরিত্র ডিজাইনার উইলিয়াম হ্যানা ও অভিজ্ঞ পরিচালক জোসেফ বারবারা। তখন ‘ক্যাপ্টেন এ্যান্ড দি কিডস’ কমিক্স স্ট্রিপের চরিত্রগুলো নিয়ে এম.জি.এম স্টুডিও ধারাবাহিক কার্টুন বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কার্টুনটি দর্শকদের মাঝে তেমন জনপ্রিয়তা সৃষ্টি করতে না পারায় স্টুডিওটি অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। এরপর ১৯৩৭ সালে উইলিয়াম হ্যানা ও জোসেফ বারবারা জুটিবদ্ধ হয়ে ছবি পরিচালনার কাজে লেগে পড়েন এবং ছবিটির প্রযোজক ছিলেন রুডলফ আইজিঙ। প্রথম ছবিটি ছিল ইঁদুর-বিড়াল নিয়ে একটি কার্টুন। যার নাম ছিল ‘পাস গেটস দি বুট’। এই কার্টুনটি তৈরির কাজ শেষ হয় ১৯৩৯ সালে। এটি প্রথম প্রদর্শিত হয় থিয়েটার হলে ১৯৪০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। কার্টুনটিতে প্রধান চরিত্রে ছিল জ্যাসপার, একটি ধূসর রঙের বিড়াল এবং সে জিনক্স নামের একটি বাদামি রঙের ইঁদুরকে ধরার চেষ্টা করে।
কার্টুনটি কোনো প্রকার সূচনা সংগীত ছাড়াই মুক্তি পায়। ইঁদুর-বিড়ালের এই কার্টুনটিকে ঘিরে স্টুডিওর অনেক কর্মীরই নেতিবাচক মনোভাব ছিল। অনেক কর্মীকে বলতে শোনা যায়, “ইঁদুর-বিড়ালের কার্টুন কি আর কম হলো?” পরবর্তী সময়ে যখন এই ইঁদুর-বিড়ালের কার্টুনটি থিয়েটার মালিক ও দর্শকদের কাছে জনপ্রিয়তা পায় এবং ১৯৪১ সালে অ্যাকাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস এন্ড সায়েন্সেসের পক্ষ থেকে ‘অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট কার্টুন শর্ট সাবজেক্ট’ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয় তখন স্টুডিওর সেই কর্মীদের নেতিবাচক ধারণার পরিবর্তন ঘটে। কার্টুনটি অবশ্য এম.জি.এম স্টুডিওর-ই আরেকটি কার্টুনের কাছে হেরে যায়। সেই কার্টুনটি ছিল রুডলফ আইজিঙের ‘দি মিল্কিওয়ে’।
এরপর এম.জি.এম অ্যানিম্যাশন স্টুডিওর প্রযোজক ফ্রেড কুইম্বলি, হ্যানা ও বারবারাকে এক পর্বের কার্টুনগুলো থেকে সরিয়ে এই ইঁদুর-বিড়ালকে নিয়ে কার্টুন সিরিজের জন্য নিযুক্ত করেন। তবে কার্টুনের বর্তমান নামটি কারো পছন্দ হচ্ছিল না বিধায় স্টুডিওতেই কার্টুনের নামকরণের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। প্রতিযোগিতায় অ্যানিমেটর জন কারের প্রস্তাব করা ‘টম এ্যান্ড জেরি’ নামটি সবার পছন্দ হলো এবং সেই সাথে কার্টুনটির নাম তাই রাখা হলো। জন কারকে এই নামকরণের জন্যে ৫০ ডলার পুরস্কার প্রদান করা হয়। এই নামটি নেওয়া হয়েছে পিয়ার্স এগান নামক লেখকের ১৮২৩ সালে প্রকাশিত বই থেকে যার নাম ‘লাইফ ইন লন্ডন অর, দি ডে এ্যান্ড নাইট সিন্সেস অব জেরি হর্থোন এ্যান্ড হিজ এলিগেন্ট ফ্রেন্ড করিন্থিয়ান টম’। ওই বছর, ১৯৪১ সাল থেকেই ‘টম এ্যান্ড জেরি’ স্টুডিওটির প্রোডাকশন তালিকায় যোগ হলো।
কার্টুনের মূল বিষয় ও চরিত্রসমূহ
কার্টুনটিতে একটি বাদামি ইঁদুর ও একটি নীলাভ ধূসর বিড়ালের মধ্যকার ঝগড়া, খুনসুটি, বন্ধুত্ব ও একে অপরের প্রতি ভালোবাসা কৌতুকপ্রদভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আর এই বিড়ালটির নাম টম ও ইঁদুরটির নাম জেরি। বিড়ালটির নাম জ্যাসপার থেকে থমাস বা টম রাখা হয় ‘দি মিডনাইট স্ন্যাক’ নামক পর্ব থেকে এবং একই সাথে ইঁদুরটির নাম জিনক্স থেকে জেরি রাখা হয় ঐ একই পর্বেই, ১৯৪১ সালে। বেশিরভাগ পর্বেই টম তার নিজের বিভিন্ন চাতুর্যপূর্ণ কৌশল ব্যবহার করে থাকে জেরিকে ধরার জন্য ও তাকে হেনস্থা করার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জেরির ধূর্ততা, ভাগ্য ও বুদ্ধির জন্য টমের বেশিরভাগ কৌশলই বিফলে যায়। তবুও প্রত্যয়ী, পরিশ্রমী ও ব্যতিক্রমী বুদ্ধিসম্পন্ন টম হাল ছেড়ে না দিয়ে জেরিকে ধরার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। তবে কয়েকটি পর্বে টম ও জেরির মধ্যে ভালোবাসাপূর্ণ সম্পর্ক, তাদের একজনের অপরজনের প্রতি নির্ভরশীলতা ও তাদের বন্ধুত্বকে চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। কার্টুনটিতে টম ও জেরি ছাড়া আরো কিছু উল্লেখযোগ্য চরিত্র রয়েছে। যেমন:
- ম্যামি টু সুজ: একজন আফ্রিকান-আমেরিকান নারী যিনি বাড়ির মালিক এবং টমকে জেরিকে ধরার ও বাড়ির দেখাশোনা করার জন্য আদেশ দিয়ে থাকেন। ১৯৪০ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত প্রায় ১৯টি পর্বে তিনি ছিলেন। প্রায় সব পর্বেই তার চেহারা দেখানো হয় নি। তবে ‘স্যাটারডে ইভেনিং পাস’ নামক একটিমাত্র পর্বে খুবই স্বল্প সময়ের জন্য তার চেহারা দেখা গিয়েছিল।
- বাচ: বাচ হলো গলিতে থাকা একটি কালো রঙের নোংরা বিড়াল যে কিছু পর্বে টমের সহযোগী আবার কিছু পর্বে টম ও জেরির শত্রু হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। বাচকে কার্টুনটিতে প্রথমবার দেখা যায় ‘বেবি পাস’ নামক পর্বে।
- স্পাইক ও টাইক: একটি ধূসর রঙের হিংস্র (একটি পর্বে স্পাইককে কিলার নামে অভিহিত করা হয়েছে) আমেরিকান বুলডগ যে বিড়াল পেটাতে পছন্দ করে এবং টাইক হলো স্পাইকের সন্তান। এদের দুজনকে বিশেষ করে স্পাইককে কিছু পর্বে জেরির বন্ধু হিসেবে দেখা গিয়েছে। স্পাইককে প্রথমবার দেখা যায় ‘ডগ ট্রাবল’ নামক পর্বে। আর টাইককে প্রথমবার দেখা যায় ‘লাভ দ্যাট পাপ’ নামক পর্বে।
- টুডলস: একটি সুন্দর ও সাদা রঙের মেয়ে বিড়াল যে টমের প্রেমিকা হিসেবে পরিচিত। তবে বাচের বেশিরভাগ সময়ই টুডলসকে টমের থেকে কেড়ে নেয়ার প্রবণতা দেখা যায়। তবে ‘কাসানোভা ক্যাট’ নামক পর্বে টুডলস জেরির সাথেও প্রণয়ধর্মী সম্পর্কে লিপ্ত হয়।
- নিবেলস বা টাফি: একটি ধূসর রঙের ডায়পার পরা ছোট্ট ইঁদুর যে কিছু পর্বে অনাথ ইঁদুর আবার কিছু পর্বে জেরির ভাতিজা ও সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। ‘দি মিল্কি ওয়েইফ’ নামক পর্বে প্রথম নিবেলস বা টাফি কে দেখা যায়।
- কুয়েকার: একটি হলুদ রঙের ছোট হাঁস যে জেরির বন্ধু। ‘লিটল কুয়েকার’ নামক পর্বে প্রথমবার কুয়েকারকে দেখা যায়।
টম ও জেরি উভয়ই নির্বাক মূল চরিত্র এই কার্টুনের। এই কার্টুনের শুধুমাত্র ম্যামি টু সুজ, বাচ, স্পাইক ও কুয়েকার, জেরির কাজিন মাসেলস, জেরির চাচা পিকোস, টমের কাজিন জর্জ এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিবেলস বা টাফি সবাক চরিত্র।
হ্যানা-বারবারা যুগ (১৯৪০-১৯৫৮, ১৯৭৫-১৯৭৭, ১৯৯০-১৯৯৪)
১৯৪১ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘টম এ্যান্ড জেরি’ কার্টুন সিরিজের কাজ শুরু হয়। ১৯৪১ সালে এর দ্বিতীয় পর্ব মুক্তি পায় যার নাম ‘দি মিডনাইট স্ন্যাক’। ১৯৪০ সাল থেকে টানা ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত উইলিয়াম হ্যানা ও জোসেফ বারবারা একত্রে কাজ করার মাধ্যমে ‘টম এ্যান্ড জেরি’-কে নিয়ে গেছেন জনপ্রিয়তার উর্ধ্বে। সব বয়সের মানুষের কাছে এই জুটির তৈরি পর্বগুলোর জনপ্রিয়তা এখনো এতোটুকু কমে যায় নি। এই সিরিজে সুরকার স্কট ব্র্যাডলি ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর সম্পাদনার কাজটি করেছিলেন অত্যন্ত চমৎকারভাবে। যার জন্য এই কার্টুনে শক্তিশালী, জীবন্ত ও হিংসাত্মক সুরের বিকাশ ঘটেছে। এছাড়াও সিরিজটিতে প্রাণবন্ত ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের ক্ষেত্রে টেক্স এভারির অবদান রয়েছে।
সিরিজটিতে হ্যানা ও বারবারা টম-জেরির শারীরিক কাঠামোর মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম পরিবর্তন এনেছিলেন। যেমন, কার্টুনটির ১৯৪০ সালের প্রথম পর্বে টমের ছিল লোমশ শরীর, মুখে অনেক ভাঁজ ও ভ্রুকে চিহ্নিত করার জন্য চোখের উপর অনেক দাগ। পরবর্তী সময়ে টমের চেহারাকে অরো মসৃণ, দেহের লোম কমিয়ে ফেলা হয় ও স্পষ্ট করে ভ্রু দেয়া হয়। অন্যদিকে জেরির শরীরকে চিকন করা হয় ও তার চোখের পাপড়িকে ছোট করা হয়।
হ্যানা-বারবারা মোট ১১৪টি পর্ব তৈরি করেছিলেন এই সিরিজটিতে। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত এই সিরিজটির প্রযোজক ছিলেন ফ্রেড কুইম্বি।
১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত প্রযোজক ছিলেন হ্যানা ও বারবারা এবং এই তিন বছর সিনেমাস্কোপ ফরম্যাটে পর্বগুলো মুক্তি দেয়া হয়। এই সিরিজটির সাতটি পর্ব অ্যাকাডেমি পুরস্কার লাভ করে ‘বেস্ট কার্টুন শর্ট সাবজেক্ট’ বিভাগে ও ১৩টি পর্ব এই বিভাগে মনোনীত হয়েছিল। প্রত্যেকটি পর্ব তৈরি করতে হ্যানা ও বারবারার প্রায় ৫০,০০০ ডলার খরচ হতো এবং তা তৈরি করতে প্রায় ৬ সপ্তাহ সময় লাগতো।
১৯৭৫ সালে হ্যানা ও বারবারার প্রযোজনায় ও চার্লস এ নিকোলসের পরিচালনায় ‘টম এ্যান্ড জেরি শো’ নামের সিরিজটি প্রতি শনিবার টেলিভিশনে দেখানো শুরু হয়। এই সিরিজে ৪৮টি পর্ব রয়েছে এবং প্রতিটি পর্বের ব্যাপ্তিকাল ৭ মিনিট।
এই সিরিজের পর্বগুলোতে কার্টুনটির চরিত্রগুলোর মধ্যে বৈরি সম্পর্ক বাদ দেয়া হয়েছে। যার কারণে পুরো সিরিজ জুড়েই টম আর জেরির মধ্যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার বন্ধনটি অধিক ফুটে উঠেছে। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এই সিরিজটি দেখানো হয়েছিল টেলিভিশনে।
এরপরে ১৯৯০ সালে হ্যানা ও বারবারার প্রযোজনায় ‘টম এ্যান্ড জেরি কিডস শো’ পরিচালনা করা হয়। যার পর্বসংখ্যা ৬৫টি ও সিজন সংখ্যা ৪টি।
জেন ডিচ যুগ (১৯৬১-১৯৬২)
১৯৬১ সালে এম.জি.এম স্টুডিও ‘টম এ্যান্ড জেরি’ ফ্র্যাঞ্চাইজি গ্রহণ করার পরে রেম্ব্রান্ডিট ফিল্মস নামের একটি ইউরোপিয়ান অ্যানিমেশন স্টুডিওর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। এই স্টুডিও থেকে জেন ডিচের রচনায় ও পরিচালনায় এবং উইলিয়াম এল স্নাইডারের প্রযোজনায় ১৩টি টম এ্যান্ড জেরি কার্টুনের পর্ব তৈরি করা হয়। পর্বগুলো তৈরি করা হয়েছিল চেকপ্রজাতন্ত্রে। পর্বগুলোর ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরে কাজ করেছেন স্টিপেন কনিচেক এবং সাউন্ড ইফেক্ট দিয়েছেন জেন ডিচ ও টোড ডকস্টাডার।
দুর্ভাগ্যবশত জেন ডিচের তৈরি পর্বগুলো হ্যানা ও বারবারার তৈরি পর্বগুলোর মতো তেমন জনপ্রিয়তা পায় নি। এই ব্যর্থতার কারণ, জেন ডিচ মাত্র ১০,০০০ ডলার দিয়ে পর্বগুলো তৈরি করেছিলেন এবং পর্বগুলোর অ্যানিমেশন তুলনামূলকভাবে দ্রুত ও চরিত্রগুলোর চলাফেরা ও অঙ্গভঙ্গি দেখতে স্বাভাবিক লাগতো না বরং অস্থিতিশীল মনে হতো। এমনকি ব্যাকগ্রাউন্ড ছবির মধ্যে কোনো সৌন্দর্য ছিল না, এটি অনেক সরল ও আর্ট ডেকো স্টাইলে তৈরি করা হয়েছিল। সেই সাথে পর্বগুলোতে টম ও জেরিকে বিভিন্ন অদ্ভুত স্থানে উপস্থাপন করে পর্বগুলো তৈরি করা হয়েছিল; যেমন, ঊনিশ শতকের হোয়েলিং জাহাজে, নাইরোবির জঙ্গলে, প্রাচীন গ্রিকের নগরদুর্গে কিংবা বর্বর পশ্চিমা অঞ্চলে।
অ্যানিমেশন, ব্যাকগ্রাউন্ড, স্থান এসবের পাশাপাশি সাউন্ড ইফেক্টও খারাপ প্রভাব ফেলেছিল পর্বগুলোতে। অনিয়মিত ও বিক্ষিপ্ত এবং প্রতিধ্বনিযুক্ত ও ভারী আধুনিক বৈদ্যুতিক সাউন্ড ইফেক্ট পর্বগুলোর আবহটাই বিপরীতমুখী তৈরি করে ফেলেছিল। যার জন্য মনে হতো পর্বগুলোর মধ্যে পরাবাস্তবতা ফুটে উঠেছে।
পর্বগুলোর শেষে ‘Made In Hollywood, U.S.A.’ বাক্যাংশটি উল্লেখ করা হতো না যেটি হ্যানা-বারবারার তৈরিকৃত পর্বগুলোর শেষে উল্লেখ করা হতো। ডিচের পর্বগুলো বাণিজ্যিক সফলতা পেলেও কোনো পর্বই কোনো পুরস্কার পায় নি এবং মনোনীতও হয় নি।
১৩টি পর্ব তৈরির কাজ শেষ হবার পর এম.জি.এম স্টুডিওর প্রধান জো ভোগেলকে তার দায়িত্ব হতে অব্যাহতি দেয়া হয়। তার চলে যাবার পর স্টুডিওর সাথে ডিচের সম্পাদিত চুক্তির মেয়াদ নবায়ন করতে চাইলেও স্টুডিওটি তা করে নি। আর এভাবেই সমাপ্তি ঘটে জেন ডিচের যুগের।
এই বছরের ১৬ই এপ্রিল জেন ডিচ অন্ত্ররোগের কারণে ৯৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
চুক জোন্স যুগ (১৯৬৩-১৯৬৭)
ওয়ার্নার ব্রোস স্টুডিও থেকে বিতাড়িত হবার পর চুক জোন্স তার নিজের স্টুডিও তৈরি করেন ‘সিব টাওয়ার ১২ প্রোডাকশন্স’ নামে, পরে যার নাম দেয়া হয় ‘এম.জি.এম অ্যানিমেশন/ ভিজুয়াল আর্টস’। এই স্টুডিওর সহ প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন লেস গোল্ডম্যান। ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত লেস গোল্ডম্যান ও চুক জোন্সের প্রযোজনায় ৩৪টি টম এ্যান্ড জেরি পর্ব তৈরি করা হয়েছিল। পর্বগুলোর পরিচালনায় ছিলেন চুক জোন্স, মরিস নোবেল, অ্যাবি লোভেটো, টম রে এবং বেন ওয়াশাম। বেশিরভাগ পর্বের সহ পরিচালক ছিলেন চুক জোন্স।
চুক জোন্স টম ও জেরির শারীরিক কাঠামোতে কিছু পরিবর্তন আনেন। যেমন, টমকে আরো ঘন ভ্রু দেওয়া হয়, আরো সরল চেহারা দেওয়া হয়, চোখা কান, লম্বা লেজ ও লোমশ গাল দেয়া হয়। সেই সাথে জেরিকে বড় চোখ ও বড় কান দেওয়া হয়, হালকা বাদামি রঙ এবং তার সাথে সুন্দর শূকরছানার মতো চেহারায় অভিব্যক্তি দেওয়া হয়।
চুক জোন্সের অ্যানিমাশনগুলো জেন ডিচের অ্যানিমেশনের তুলনায় ভালো ছিল। তবে চুক জোন্সের সিরিজের পর্বগুলোও কোনো পুরস্কার লাভ করে নি এবং কোনো পুরস্কারের জন্যে মনোনীতও হয় নি বাণিজ্যক সফলতা লাভ করার পরেও। ১৯৬৭ সালে এম.জি.এম স্টুডিও টম এ্যান্ড জেরি কার্টুন নিয়ে কাজ করা বন্ধ করে দেয় আর এভাবেই সমাপ্তি ঘটে চুক জোন্সের যুগের।
টেলিভিশন
১৯৬৫ সালে হ্যানা ও বারবারার তৈরি টম এ্যান্ড জেরি কার্টুন টেলিভিশনে দেখানো শুরু হয়। কার্টুনটি প্রথমবার দেখানো হয় ‘সিবিএস’ (কলাম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সিস্টেম) চ্যানেলে। তখন প্রত্যেক শনিবার সকালে দেখানো হতো। এরপর ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত প্রত্যেক রবিবারে সিবিএস চ্যানেলে টম এ্যান্ড জেরি দেখানো হতো।
ফিল্মেশন যুগ (১৯৮০-১৯৮২)
ফিল্মেশন স্টুডিওস ‘দি টম এ্যান্ড জেরি কমেডি শো’ নামে ১৯৮০ সালে একটি সিরিজ পরিচালনা করে। এই সিরিজটি সিবিএস চ্যানেলে ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত প্রত্যেক শনিবার সকালে দেখানো হয়েছিল।
এই সিরিজে কিছু নতুন নতুন চরিত্র দেখা গিয়েছিল। যেমন, ড্রুপি, বার্নি বিয়ার। এই সিরিজটি হ্যানা ও বারবারার তৈরি পর্বগুলোর থেকে অনেক ভিন্ন ছিল। আর এই সিরিজে টম আর জেরিকে দেখতে কিছুটা ১৯৭৫ সালের ‘টম এ্যান্ড জেরি শো’ এর টম আর জেরির মতো লেগেছে। এবং এই সিরিজে হাস্যরসের ধরনও ভিন্ন ছিল। এসব ভিন্নতার ফলে এই সিরিজটি দর্শকদের কাছে ভালো সাড়া পায় নি।
১৯৮৬ সালে ওয়ার্নার ব্রোস স্টুডিওর প্রতিষ্ঠাতা টেড টার্নার এম.জি.এম স্টুডিওকে কিনে নেয়। এরপরে টম এ্যান্ড জেরি ওয়ার্নার ব্রোস স্টুডিওর নিজস্ব বিভিন্ন চ্যানেলে (কার্টুন নেটয়ার্ক, টিএনটি, টিবিএস, দি ডব্লিউবি, বুমেরাং) দেখানো শুরু হয়।
২০০১ সালে কার্টুনটির একটি সিরিজ ছাড়া পর্ব মুক্তি পায় যার নাম ‘টম এ্যন্ড জেরি: দি ম্যানসন ক্যাট’। এটি প্রথমবার বুমেরাং চ্যানেলে দেখানো হয়। পর্বটির ব্যাপ্তিকাল ৮ মিনিট।
২০০৫ সালে কার্টুনটির আরেকটি সিরিজ ছাড়া পর্ব মুক্তি পায় যার নাম ‘দি কারাটে গার্ড’। পর্বটি প্রথমবার দেখানো হয় লস এঞ্জেলস সিনেমাতে। এই পর্বটি তৈরি করা হয়েছিল টম এ্যান্ড জেরি কার্টুনের ৬৫তম বার্ষিকী উপলক্ষে।
এটি কার্টুনটির ১৬৩তম পর্ব ও এর ব্যাপ্তিকাল ৮ মিনিট। এই পর্বটি রচনা ও পরিচালনা করেছেন জোসেফ বারবারা ও স্পাইক ব্র্যান্ডিট। পর্বটির মুক্তির পরে ২০০৬ সালের ১৮ই ডিসেম্বর টম এ্যান্ড জেরির অন্যতম স্রষ্টা জোসেফ বারবারা মৃত্যুবরণ করেন।
ওয়ার্নার ব্রোস যুগ (২০০৬-বর্তমান)
২০০৬ সালে ‘টম এ্যান্ড জেরি টেলস’ নামে একটি সিরিজ টেলিভিশনে দেখানো শুরু হয়। এই সিরিজের পর্বসংখ্যা ২৬টি এবং সিজন সংখ্যা ২টি। প্রতিটি পর্বের ব্যাপ্তিকাল ২৩ মিনিট।
২০০৬ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এই সিরিজের পর্বগুলো বুমেরাং, ডব্লিউবি কিডস ও দি সিডব্লিউ চ্যানেলে দেখানো হতো। ২০০৮ সালে ডব্লিউবি কিডস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ২০১২ সাল থেকে কার্টুন নেটয়ার্কে এই সিরিজটি দেখানো শুরু হয়।
২০১৪ সাল থেকে ‘দি টম এ্যান্ড জেরি শো’ নামে একটি সিরিজ দেখানো শুরু হয় কার্টুন নেটওয়ার্কে। এটি পরিচালনা করেছেন ড্যারেল ভ্যান কিটারস। এর সিজন সংখ্যা ৩টি ও পর্বসংখ্যা ৭৮টি।
২০১৬ সাল থেকে ডব্লিউবি কিডস তাদের ইউটিউব চ্যানেলে টম এ্যান্ড জেরির পর্বগুলো আপলোড করার পদক্ষেপ নেয়। ২০১৭ সালে পর্বগুলোর বিভিন্ন সংকলন আপলোড করা হয়।
চলচ্চিত্র
১৯৯২ সালে টম এ্যান্ড জেরির প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘টম এ্যান্ড জেরি-দি মুভি’ মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রটি প্রথম মুক্তি পায় ১লা অক্টোবর, ১৯৯২ সালে জার্মানিতে। এটি রচনা ও পরিচালনা করেছেন ফিল রোমান।
টম এ্যান্ড জেরির সব চলচ্চিত্রই হোম মিডিয়াতে মুক্তি দেয়া হয়। এবং এর সব চলচ্চিত্রই প্রযোজনা করেছে ওয়ার্নার ব্রোস স্টুডিও। ১৯৯২ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কার্টুনটির ১৪টি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে। আগামী বছর অর্থ্যাৎ ২০২১ সালে কার্টুনটির দুইটি চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কমিক স্ট্রিপ
১৯৪২ সালে প্রথম টম এ্যান্ড জেরিকে দেখা যায় ডেল কমিকস বইতে। ১৯৪৯ সালে টম এ্যান্ড জেরির কমিক বই প্রকাশিত হয়।
টম এ্যান্ড জেরির কমিক স্ট্রিপ প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৫০ সালে। ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ফ্রেড কুইম্বি এটির লেখক ছিলেন এবং ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত এটির লেখক ছিলেন কেলি জারভিস। ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত সাউথ আমারিকান এডিটর প্রেস সার্ভিস এর কমিক স্ট্রিপ প্রকাশ করতো।
এছাড়াও টম এ্যান্ড জেরির বিভিন্ন ভিডিও গেম রয়েছে। যেগুলো বিশ্বব্যাপী বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এই বছরে টম এ্যান্ড জেরি কার্টুনটির ৮০ বছর পূর্ণ হয়েছে তবুও এখনো মানুষ আগের মতোই আগ্রহ নিয়ে দেখে কার্টুনটিকে। এই কার্টুনটির সাথে বেশিরভাগ মানুষেরই শৈশবের স্মৃতি, আবেগ ও ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। এভাবেই যুগ যুগ ধরে এই ইঁদুর-বিড়ালের জুটিটি দর্শকদের ভালোবাসা পেয়ে যাক আর কার্টুন জগতে তাদের জনপ্রিয়তার শীর্ষ স্থান ধরে রাখুক।
Feature Image Courtesy: pinterest.com
References:
- tomandjerry.fandom.com
- imdb.com