কোয়ারেন্টিন শব্দটিকে নিশ্চয়ই নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ২০২০ সালের ১১ মার্চ WHO করোনা ভাইরাসকে প্যান্ডেমিক ঘোষণার পর থেকেই পুরো পৃথিবী এক প্রকার অচল অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। শুয়ে বসে দিন কাটানোর জন্য আমরা যতই স্বপ্ন দেখিনা কেনো আদতে এইভাবে সময় কাটানো শুধু কষ্টকর বললে ভুল হবে; ব্যাপারটি বেশ কষ্টসাধ্য। এক নিবিষ্টে কোনো কাজে মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা অনেকেরই নেই। তাও আবার সম্পূর্ণ ঘরেবন্দী অবস্থা যদি হয় তাহলে ব্যাপারটি হয়ে দাঁড়ায় আরো দুঃসহ। তবে কোয়ারেন্টিন কিছু মানুষের জন্য হয়ে এসেছিলো আশীর্বাদ স্বরুপ। তাই আপনি চাইলেই এসব মানুষদের কর্মকান্ড সম্পর্কে অবিহিত হয়ে নিজেকে ঘরে বেঁধে রাখার পাশাপাশি সৃজনশীল কিছু করতে অনুপ্রাণিত হতে পারেন। আজ আমরা দেখবো কোয়ারেন্টিনকে সর্বোচ্চ উপায়ে কাজে লাগিয়েছেন এমন কয়জন ব্যক্তিকে।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার
উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের রচিত সবচেয়ে শ্রেষ্ট নাটক কোনটি? এমন প্রশ্নে অনেকগুলো নাটকের নাম আসাই স্বাভাবিক। তবে সেই নামগুলোর মধ্যে কিং লিয়ার কিংবা ম্যাকবেথ এর নাম না থাকাটাই হবে অস্বাভাবিক। মজার ব্যাপার হলো এই বিখ্যাত নাটকগুলো শেক্সপিয়ার লিখেছিলেন কোয়ারেন্টিনে আবদ্ধ থেকে।

শেক্সপিয়ারের নাটকগুলো সাধারণত মঞ্চায়ন করা হতো কিংস ম্যান থিয়েটারে। যে থিয়েটারের কিছু অংশের মালিকও ছিলেন এই গুণী লেখক। পাশাপাশি নিজের মঞ্চায়িত বেশ কয়েকটি নাটকে স্বয়ং শেক্সপিয়ায়রই অভিনয় করেছিলেন। ১৭ শতকের শুরুর দিকে লন্ডন শহরে প্লেগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম সপ্তাহেই ৩০ জন মানুষের মৃত্যুতে পাবলিক থিয়েটারগুলো বন্ধ করতে বাধ্য হয় কতৃপক্ষ। অর্থাৎ ১৬০৬ সালের সময়কালে লন্ডনের সবগুলো থিয়েটার ছিলো বন্ধ অবস্থায়। কাজ বিহীন শেক্সপিয়ারও ছিলেন ঘরে আবদ্ধ। আর নিজের এই কোয়ারেন্টিন সময়টাকে দারুন ভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন। এই সময়ের মধ্যে ঘরে বসে তিনি রচনা করেছেন কিং লিয়ার, ম্যাকবেথ, এন্টনিও ও ক্লিওপেট্রার মতো বিখ্যাত সব নাটকগুলো। যেগুলো কিনা সাহিত্যের ইতিহাসের পাতায় এখনো জ্বলজ্বল করছে।

আইজ্যাক নিউটন
শেক্সপিয়ার এর কোয়ারেন্টিন সময়কাল এর কিছু দশক পরেই আবারো কোয়ারেন্টিনে যেতে বাধ্য হয় লন্ডন সহ পুরো ইংল্যান্ডের অধিবাসী। কারণ সেই একই, প্লেগ। এবার শুধু লন্ডন নয়, প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে পুরো ইংল্যান্ডেই। তবে এইবার এই মহামারী আকার ধারণ করে আরো ভয়াবহ রুপে। ইংরেজি পঞ্জিকায় তখন বর্ষ ১৬৬৫ সন। বরেণ্য বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন তখন একেবারে তাগড়া জোয়ান। ক্যাম্ব্রিজে সবেমাত্র ক্লাস শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু প্লেগের ধাক্কায় পুরো শহর কোয়ারেন্টাইনে যেতে বাধ্য হয়। ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় সহ আশেপাশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষনা করা হয়।

নিউটনও তাই চলে যান শহর থেকে ৬০ মাইল দূরে অবস্থিত নিজের পারিবারিক বাড়িতে। নিজেকে ঘরে আবদ্ধ করে এই সময়টাতে দারুন জিনিস আবিষ্কার করে বসেন নিউটন। গণিতের জগতে আমূল পরিবর্তন এনে দেওয়া ক্যালকুলাস এর আবিষ্কার হয় নিউটনের কোয়ারেন্টাইন থাকা অবস্থাতেই। শুধু ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেই ক্ষান্ত থাকেননি এই মহাবিজ্ঞানী। নিজের শোবার ঘরে রাখা প্রিজম নিয়ে ঘাটাঘাটি করে আবিষ্কার করেন অপটিকস নিয়ে দেওয়া তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সব তত্ত্ব। যা কিনা বিজ্ঞানকে এক ধাক্কায় এগিয়ে নিয়েছে অনেকদূর।
তবে অনেকের মতে নিউটন তাঁর বিখ্যাত মহাকর্ষ বলের সূত্রগুলোও আবিষ্কার করেছিলেন তৎকালীন সময়েই। মাথায় আপেল পড়ার পরিবর্তে ঘটনাটি ছিলো এইরকম যে কোয়ারেন্টিন অবস্থায় বাসায় বদ্ধ থাকাকালীন নিউটন একদিন নিজের শোবার ঘরের জানালা দিয়ে গাছ থেকে আপেল পড়তে দেখেন। সেই ঘটনা ধরে এগুতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন মহাকর্ষ বলের তিনটি সূত্র। যদিও এই আবিষ্কারটি নিউটন আদৌ কোয়ারেন্টিন অবস্থায় করেছিলেন কি-না তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে ক্যালকুলাস আর প্রিজমের সূত্রগুলো তিনি আবিষ্কার করেছিলেন প্লেগের মহামারীর সময়কালেই।

এডভার্ড মুঞ্চ
পৃথিবীর সবচেয়ে দামী তৈলচিত্র কোনটি তা না জানলেও ‘দ্য স্ক্রিমার’ ছবিটি জীবনে দেখেননি এইরকম মানুষ পাওয়াই ভার। বিখ্যাত এই তৈলচিত্রটি লন্ডনের এক নিলামে ১২ মিনিটের মধ্যেই বিক্রয় হয়ে গিয়েছিলো। দাম উঠেছিলো ১১৯.৯ মিলিয়ন ডলার। ১৮৯৫ সালে আঁকা বিখ্যাত এই ছবিটির চিত্রকর ছিলেন নরওয়েজিয়ান চিত্রশিল্পী এডভার্ড মুঞ্চ। তবে এই চিত্রটি তিনি কোয়েরান্টাইনে বসে আঁকেননি।

১৯১৯ সালে প্যান্ডেমিক ঘোষিত স্প্যানিশ ফ্লু পুরো দুনিয়া নাড়িয়ে দিলে অনেকের পাশাপাশি এই চিত্রশিল্পীও আক্রান্ত হন স্প্যানিশ ফ্লু তে। সেই সময় অন্যান্য সবার মতো এডভার্ড মুঞ্চকেও থাকতে হয় কোয়েরান্টাইন অবস্থায়। আর নরওয়েতে অবস্থানকালে এই কোয়েরান্টাইন সময়টাকে কাজে লাগিয়ে তিনি এঁকে ফেলেন ‘পোট্রেইট উইথ দ্য স্প্যানিশ ফ্লু’ নামের বিখ্যাত তৈলচিত্রটি। সেখানে নিজেরই একটি পোট্রেইট আঁকেন মুঞ্চ। তাতে দেখা যায় অস্থিচর্মসার মুঞ্চ স্প্যানিশ ফ্লু তে অসহায় অবস্থায় হেলান দিয়ে বসে আছেন নিজ চেয়ারে। বর্তমানে এই বিখ্যাত চিত্রটি নরওয়ের মেট্রোপলিটন জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।

থমাস ন্যাশ
থমাস ন্যাশ ছিলেন শেক্সপিয়ার এর সময়কার একজন গুণী নাট্যকার। বেশ খ্যাতি লাভ করলেও তিনি অনেকটা আড়ালে পড়ে গিয়েছিলেন শেক্সপিয়ারের জন্যই। এলিজাবেথিয়ান নাট্যকার হিসেবে বেশ খ্যাতি লাভ করা থমাস ন্যাশও পড়েছিলেন প্লেগের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে। ১৫৯২ সালে লন্ডনে প্লেগের মহামারীতে বাধ্য হয়ে শহর ছেড়ে পালান তিনি। সংক্রমণ এড়াতে আশ্রয় নেন শহরের ধারেই এক গ্রামে। আর একাকী কোয়ারেন্টিন এই সময়টাতেই পূর্ণ মনোযোগে লেখায় মনোনিবেশ করেন এই নাট্যকার। তখনই তিনি লিখে ফেলেন তাঁর অমরকীর্তী ‘সামারস লাস্ট উইল এন্ড টেস্টামেন্ট’। যে নাটকে তিনি প্লেগের মহামারী ও সাধারণ জীবনযাপনের কষ্ট ও দুর্দশা সুনিপুণ ভাবে তুলে ধরেন।

‘সামারস লাস্ট উইল এন্ড টেস্টামেন্ট’ নাটকের একটি বিখ্যাত অংশ নিচে দেওয়া হলো:
Adieu, farewell earths blisse,
This world uncertaine is,
Fond are lifes lustful joyes,
Death proves them all but toyes,
None from his darts can flye;
I am sick, I must dye:
Lord, have mercy on us.

জিওভানি বক্কাচিও
বরেণ্য ইতালিয়ান কবি ও লেখক জিওভানি বক্কাচিও নিজের কোয়ারেন্টিন সময়কে কাজে লাগিয়েছেন দারুণভাবে। ফ্লোরেন্সে জন্মগ্রহণ করার হেতু তিনি বিখ্যাত ছিলেন ফ্লোরেন্টাইন কবি হিসেবে। জন্মের পাশাপাশি তাঁর বেড়ে উঠাও ফ্লোরেন্স শহরে। কিন্তু ১৩৪৮ সালে প্লেগ আবারো হানা দেয় ইতালির এই সমৃদ্ধ শহরে। বক্কাচিওর বাবা ও সৎ মা আক্রান্ত হন প্লেগে। উপায়ন্তর না দেখে এক প্রকার ফ্লোরেন্স থেকে পালিয়ে তিনি আশ্রয় নেন শহরের দূরবর্তী গ্রাম টুসকানে। সেখানে গ্রামবাসীদের সাথে কোয়ারেন্টিন অবস্থায় একঘেয়েমিতা কাটানোর জন্য নানা ধরনের গল্প বানিয়ে শুনাতেন বক্কাচিও। পরবর্তীতে সেগুলোকেই লিখে রাখার চিন্তা আসে তাঁর মাথায়।

সেই টুসকান গ্রামে বসেই গল্পগুলোকে উপন্যাসিকা আকারে লিখে লিখে একটু পান্ডুলিপি তৈরী করেন তিনি। যেটি পরবর্তীতে ‘ডেকামেরন’ বই আকারে প্রকাশিত হয়। মূলত প্লেগকে কেন্দ্র করেই লেখা হয়েছিলো সবগুলো গল্প। বর্তমান সাহিত্যের জগতে বক্কাচিও এর এই বইটিকে ধরা হয় উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে।
কোয়ারেন্টিনের এই অলস সময়কে আপনিও চাইলে নানা ভাবে কাজে লাগাতে পারেন। এই বরেণ্য ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেই করে ফেলতে পারেন তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো কোনো কাজ।
Feature Image Courtesy: newsviews.media