আজ এক অন্য গল্প শুনাব। রুপকথার কোন কাব্য নয়, নয় কোন পদ্য। এর পরতে পরতে শুধুই হাহাকার আর বেঁচে থাকার আকুতি। ২০১১ সাল, আরব বসন্তের ঢেউ একের পর এক ভীত নাড়িয়ে দিচ্ছে ক্ষমতায় জোকের মতো জেঁকে বসা স্বৈরশাসকদের। বাতাসে বিদ্রোহের আভাস। ইয়েমেনে সালেহের দীর্ঘ দুইদশকের শাসনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, দুর্নীতি আর মধ্যেপ্রাচ্যের সবচেয়ে দরিদ্র দেশের তারুণ্য যে ঘুনে ধরা কাঠের মত মিলিয়ে না গিয়ে বজ্রকঠিন হতে পারে তা কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিল কেউ? আলজেরিয়া, লিবিয়া, মিশর পেরিয়ে এ বিপ্লব আছড়ে পরে লোহিত সাগরের তীরবর্তী মধ্যেপ্রাচ্যের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ ইয়েমেনে। অপশাসনের জাতাকলে পিষ্ট হওয়া তরুণদের জোরালো আওয়াজে সেদিন বোধহয় কেপে ওঠেছিল লোহিত সাগরের শান্ত জলরাশিও। এ বিপ্লব সম্পর্কে পরে বিস্তারিত জানব। তার আগে আসুন এক নজরে জেনে নেই এর অতীত ইতিহাস।

ইয়েমেনের ইতিহাস
আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তের মরুভূমি বেষ্টিত এক দরিদ্র দেশ ইয়েমেন। এর মোট আয়তনের অর্ধেকের বেশিই মরুভূমি এবং বসবাসের অযোগ্য। পৃথিবীতে যতগুলো প্রাচীন জনপদ রয়েছে তার মধ্যে ইয়েমেন অন্যতম। এর প্রতিবেশি দেশ সৌদি আরব এবং ওমান। প্রাচীনকালে এর জনপদ অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র ছিল এর রাজধানী শহর সানা। কিন্তু বিভিন্ন কারণে ধীরে ধীরে এলাকাটির গুরুত্ব হ্রাস পায় এবং তাদের ভাগ্যের উন্নয়নও খুব একটা হয় নি। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২৩০০ মিটার উচুতে অবস্থিত এর রাজধানী সানাকে বিশ্বের সবচেয়ে উচু শহরগুলোর একটি বলা হয়। ইউনেস্কো একে ‘ওয়াল্ড হেরিটেজ অফ মেনকাইন্ড’ বলে ঘোষণা করেছে। প্রাচীন শহর হওয়ায় এতে প্রচুর প্রাচীন স্থাপত্যের সমাহার দেখা যায়। ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ২,০০০ অব্দের দিকে উত্তর ইয়েমেনে প্রথম জনবসতি গড়ে ওঠে। খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দের দিকে এ অঞ্চল ব্যবসায়ের জন্য বিখ্যাত হতে শুরু করে। এ সময়ে ইথিওপিয়া এ অঞ্চল দখল করে। পরবর্তী প্রায় ১৩০০ বছর এ অঞ্চলের বিভিন্ন উপজাতি ও ধর্মীয় গন্ডগোল লেগেই থাকতো।

পরবর্তী সময়ে ১৫১৭ থেকে ১৯১৮ পযর্ন্ত ইয়েমেনের উত্তর অংশ অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। যদিও ১৮৩৯ সালে এর এডেন উপতাক্য ব্রিটেন দখল করে নেয় এবং ১৯৩৭ সাল পযর্ন্ত দখল করে রাখে। ১৯৬৭ সালে দক্ষিণ ইয়েমেন পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করে এবং কমিউনিস্ট মতাদর্শে পরিচালিত হতে থাকে। অবশেষে ১৯৯০ সালে দুই ইয়েমেন দীর্ঘ সময় পর একত্রিত হয়ে বৃহত্তম ইয়েমেন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। যদিও জনগণের ভাগ্যের খুব একটা পরিবর্তন হচ্ছিল না। বিংশ শতাব্দীর শেষে তেলের খনির আবিষ্কার দেশটির জনগণের আশার আলো হয়ে আবির্ভূত হলেও দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে তা জীবনমানের খুব বেশি একটা পরিবর্তন ঘটায়নি। বরং আরব বসন্তের পর জনগণের অবস্থা এতটাই খারাপ হয় যে দুর্ভিক্ষের অভিশাপ হানা দেয় দেশটিতে।

ইয়েমেন সংকট (২০১১ থেকে বর্তমান)
দুই দশক ধরে চলা সালেহর শাসনের বিরুদ্ধে তরুণদের বিপ্লবে ক্ষমতা মনসুর হাদির কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য হন সালেহ। ক্ষমতায় এসেই নতুন প্রেসিডেন্ট হাদি বিবাদমান গোষ্ঠীগুলোকে একত্র করতে এবং আল কায়দাসহ জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে দমন করার চেষ্টা করেন। অন্যদিকে দেশের সেনাবাহিনীর দুর্বলতার সুযোগে দেশের উত্তর দিকে প্রভাব বিস্তার করা ইরান সমর্থনপুষ্ট শিয়া বিদ্রোহী হুথিরা দেশটির সানা প্রদেশ দখল করে নেয়। শিয়া প্রধান দেশটির জনগণের সমর্থন ও সেনাবাহিনীর এক পক্ষের হুথিদের দিকে ঝুকে পড়ায় হুথিরা সহজেই দেশটির প্রাণকেন্দ্র সানা দখলে নেয়। শুধু সানাই না, প্রায় উত্তরাংশের পুরোটা দখলে নেয়। প্রাণভয়ে দেশ ছেড়ে সৌদিতে আশ্রয় নেন প্রেসিডেন্ট আবদুল মনসুর আল হাদি।

২০১৫ তে সৌদির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন এমবিবিএসখ্যাত যুবরাজ সালমান। বিশ্বে তার প্রভাব দেখাতেই মূলত তিনি অভিযান শুরু করেন ইয়েমেনব্যাপী। মূলত প্রেসিডেন্ট হাদিকে ক্ষমতায় বসানোই তার মূল লক্ষ্য ছিল। আকাশ থেকে একের পর বোমা পড়তে থাকে ইয়েমেনের প্রাণকেন্দ্র সানার ওপরে। গোয়েন্দা তথ্য ও অস্ত্র দিয়ে তাদের সাহায্য করে আমেরিকা, ফ্রান্স। হাসপাতাল, বিয়ের অনুষ্ঠান এমনকি রাজধানীর খাদ্য গুদামও বাদ যায়নি এই নিশংস হামলা থেকে। গত পাচ বছরে সৌদির অস্ত্র আমদানির পরিমাণ প্রায় ১২০ শতাংশ বেড়েছে। হুথিরাও রকেট হামলা চালাতে থাকে সৌদির অভ্যন্তরে। ওদিকে দেশের দক্ষিণাংশে আরব আমিরাত সমর্থিত এসটিসি বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসে এবং পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে যুদ্ধ শুরু করে।

ইয়েমেন যূদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি
দীর্ঘ পাচ বছরব্যাপী চলি যুদ্ধে ব্যাপক মানবিক বিপর্যয় ঘটিয়েছে। অধিকার ও উন্নয়ন বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধের কারণে ইয়েমেনের ১৫ টি বিমান বন্দর, ১৪ টি সমুদ্র বন্দর, দুই হাজার ৭০০ টি মহাসড়ক ও সেতু, ৪৪২ টি যোগাযোগ কেন্দ্র, ১৮ শ’৩২টি সরকারি প্রতিষ্ঠান, চার লাখ ২৮ হাজার ৮০০ টি আবাসিক ভবন, ৯৫৩ টি মসজিদ, ৩৪৪ টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও হাসপাতাল, ৯১৪ টি স্কুল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ১৭৮ টি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র, ৩৫৫ টি কারখানা, ৭৭৪ টি খাদ্য বিক্রয় কেন্দ্র এবং ৩৭০ টি তেল পাম্প স্টেশন হয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অথবা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।

পশ্চিম এশিয় অঞ্চলে রেডক্রিসেন্টের মুখপাত্র সারা আল জুগ্ধারি কিছুদিন আগে বলেছেন, ‘ যুদ্ধ অব্যাহত থাকায় ইয়েমেনের বিভিন্ন শহরে জনগণের কাছে ত্রাণ সাহায্য পৌঁছে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। দেশটির মাত্র ৫১ শতাংশ হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্র চালু রয়েছে। এছাড়া খাদ্য, চিকিৎসা ও ওষুধের অভাবে বিভিন্ন ধরনের রোগের বিস্তার ঘটছে।

দু’চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে শুরু হওয়া তরুণদের বিপ্লব আজ মরার উপর খাড়ার ঘায়ে রুপ নিয়েছে। শীঘ্রই যুদ্ধ না থামলে ইয়েমেন হবে বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র রাষ্ট্র। লাশের সারিতে ছেয়ে যাবে ইয়েমেন উপতাক্য। প্রতাপশালী দেশের কাড়াকাড়ি আর নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের জায়গায় পরিণত হওয়া ইয়েমেনের বুক চিরে কলিজা বের করার উৎসব যে শকুনের উল্লসিত চোখকে আরো উল্লসিত করছে। দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে বিপ্লব শুরু করা তরুণরা আজো স্বপ্ন নিয়ে ঘুমায়। পৃথিবীর সকাল হলেও ইয়েমেনের সূর্য আজও অস্ত।